ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩ ফাল্গুন ১৪৩১

ঐতিহ্যবাহী জামাইমেলা

প্রকাশিত: ২০:৩১, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঐতিহ্যবাহী জামাইমেলা

মানবসভ্যতার ইতিহাসে পৃথিবীর প্রতিটি জনপদের রয়েছে কিছু নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও প্রথা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। একটি দেশের সংস্কৃতিই ওই দেশের স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে। দেশের শত সহস্র মেলার ভিড়ে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী জামাইমেলা অন্যতম। ৪শ’ বছরের বেশি পুরনো এই মেলায় এবারের আকর্ষণ ছিল ৩৫ কেজি ওজনের বৃহৎ আকারের মাছ এবং ১৫ কেজি ওজনের মাছের আকৃতিতে তৈরি বড় মিষ্টি। যদিও এর নাম সন্ন্যাস বা পোড়াদহমেলা, কিন্তু হাল আমলে জামাইমেলা হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার কারণ, আশপাশের ২ শতাধিক গ্রামের জামাইসহ কুটুমরা এই মেলায় আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ঐতিহ্যবাহী এই মেলা বসে বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে গাবতলী উপজেলার মহীষাবান ইউনিয়নের ইছামতি নদীর তীরে পোড়াদহ এলাকায়। এ মেলা থেকে বিভিন্ন বাড়ির জামাইরা বড় মাছ কিনে হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে যান শ^শুরবাড়ি, সঙ্গে থাকে মিষ্টিসহ অন্যান্য পণ্য। এ সময়, মেলা ঘিরে জামাইদের কদর বেড়ে যায়। ঈদ-পার্বণে মেয়ে জামাইকে দাওয়াত না করলেও মেলায় দাওয়াত করতেই হবেÑ এটাই এ অঞ্চলের রেওয়াজ।
মূল মেলার পরদিন বসে নারীদের জন্য বউমেলা, যেখানে পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কাঠের সামগ্রী থেকে আসবাবপত্র ও সাজসজ্জার পণ্য, তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে মেলা প্রাঙ্গণ থাকে ভরপুর। রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার অথবা ফাল্গুনের প্রথম বুধবারে সন্ন্যাসী বা পোড়াদহমেলা বসে। প্রাচীন এই মেলার জন্ম নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও এটির গোড়া পত্তন হয়েছিল পোড়াদহের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতি নদীর ধারে বটগাছকে ঘিরে।
‘বাংলাদেশের মেলা’ গ্রন্থের তথ্য মতে, দেশের ৬৪ জেলায় প্রতিবছর আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় উপলক্ষে ১ হাজার ৭৮৮টি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শত শত বছর ধরে চলে আসা মেলাগুলোতে মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে যেসব তৈজসপত্র প্রয়োজন, তার সবটাই পাওয়া যায়। বঁটি, ছুরি, কাঁচি, মাটির হাঁড়ি, সরা, কলস, বদনা, বাসন, নানা রকম খেলনা, জাল, পলো, খারা, গামছা, কাচা, ধুতি, লুঙ্গি, পিঁড়ে, ব্যালোন, চরকা, লাঙল, ফাল, ঝুড়ি, ডালা, কুলো, চালন, ঝাঁপি, তামা-পিতল-সোনার কানের দুল, বাজুবন্ধ, রিং, নাকফুল, আংটি, হারসহ নানা জিনিস। এ ছাড়া কুটির শিল্প পণ্য তো আছেই। প্রতিটি বাংলাদেশীর শৈশব-কৈশরে চিরায়ত গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী মেলার স্মৃতি নেই, এমনটি হতেই পারে না। গ্রামের মেঠোপথের ধারে কিংবা নদীর তীরে বটগাছের তলায় গ্রামীণমেলা বয়ে আনে আনন্দের বন্যা। গ্রামীণমেলার উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তার মূলত প্রাচীনকাল থেকে বসবাসরত এ অঞ্চলের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ধর্ম বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠানের মিশেলে। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ দ্বিধাহীন চিত্তে মিলিত হন পরস্পরের উৎসবে। ফলে, তৈরি হয় এক অনন্য সম্প্রীতি। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, পরস্পর পণ্য বিনিময়, জ্ঞান আহরণ ও বিতরণ এবং মতবিনিময় করেন তারা। ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষ, নির্বিবাদে, ভেদাভেদ ভুলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হোক দেশের প্রতিটি ঐতিহ্যের স্মারক।

×