
কথায় আছে আজকের শিশু আগামী দিনে ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ আজকে যারা শিশু আছে, ভবিষ্যতে তারাই জাতির কর্ণধার হবে এবং দেশের হাল ধরবে। এই শিশু শ্রেণির বিরাট একটি অংশ বিভিন্ন ধরনের বঞ্চনা ও অবহেলায় পথের ধারে মানবেতর দিন-রাত যাপন করে। যাদের আমরা পথশিশু নামে বেশিই চিনি। পথশিশু বলতে তাদের বোঝানো হয়, যারা রাস্তা বা অনিরাপদ পরিবেশে বসবাস করে এবং তাদের পরিবার বা অভিভাবকদের সহায়তা ছাড়াই জীবনযাপন করে অথবা যারা দিনে রাস্তায় কাজ করে কিন্তু রাতে কোনো না কোনো আশ্রয়ে ফিরে যায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তাদের নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা ছিল সরকার ও জাতির, তার কিঞ্চিৎ পরিমাণেও হয় না। মাঝে মধ্যে তাদের কথা জাতি বা সরকারের সামনে তুলে ধরা হলেও, সেটা ওখানেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তবায়নে সামনে আর অগ্রগতি হয় না। যদি এই পথশিশুদের পথ থেকে তুলে এনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয়, প্রকৃত শিক্ষা ও মনুষ্যত্ববোধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, দেখা যাবে তারাই দেশ ও জাতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বাংলাদেশের পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ৩৪ লাখ। পথশিশুরা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর একটি অংশ। তারা পরিবার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও মৌলিক মানবাধিকারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ব্যস্তময় শহরের রাস্তা, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও বস্তিগুলোতে এদের দেখা মিলে। ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেটের বড় শহরগুলোতে এদের সংখ্যা অনেক বেশি। পথশিশুরা সাধারণত রাস্তা, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, বস্তি এবং বাজার এলাকায় বসবাস করে। তারা পেটের তাগিদে ভিক্ষাবৃত্তি, হকারি বা ছোটখাটো বেচাকেনা, আবর্জনা সংগ্রহ, গাড়ি পরিষ্কার, মাদক পরিবহন বা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হওয়ার মতো বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে থাকে।
পথশিশু এমনি এমনি তৈরি হয় না। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কারণ হলো পরিবার ভাঙন ও অভিভাবকদের মৃত্যু। আমাদের দেশে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের ফেলে দিয়ে অন্যত্র চলে যান বা অন্য কারোর সঙ্গে বিয়ে করে সংসার করেন। তাদের খোঁজখবর নেয় না। অথবা সন্তান অবুঝ অবস্থায়, তারা মারা গেলে কেউ আর দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখায় না। যার ফলে তারা জীবন টিকিয়ে রাখতে এই পথ বেচে নেয়। দ্বিতীয়ত, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। অনেক পথশিশুর খোজ নিলে দেখা যায়, তাদের বাবা-মা আছে। কিন্তু তারা তাদের সন্তানের খরচ বহন করতে সক্ষম না বা সামর্থ্য নেই। যার ফলে তারা বাধ্য হয়ে তাদের সন্তানদের এই পথ দেখিয়ে দেয়। তৃতীয়ত, শহর অভিমুখী। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে তারা তাদের বাড়ি-ঘর পরিবারের অন্য সদস্য বা এলাকার নেতা কর্তৃক বাস্তুচ্যুত হয়। অথবা নদী অঞ্চল এলাকার মানুষ নদী ভাঙন বা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কারণে তাদের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে যায়। যার ফলে তারা শহরে এসে রাস্তা-ঘাটে জীবন কাটায়। চতুর্থত, অপরাধচক্র বা শিশু পাচার। কিছু অসাধু ও স্বার্থান্বেষী চক্র শিশুদের নিয়ে এসে তাদের কাজে ব্যবহার করে। ভিক্ষা, চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন খারাপ কাজে তাদের ব্যবহার করে। তাদের বাসস্থান হয় পথের ধারে।
পথশিশুদের সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার ও জাতির বেশকিছু চ্যালেঞ্জিং কাজ করা আবশ্যক। যাতে বাংলাদেশে পথশিশুর সমস্যা দূরীকরণ করার ক্ষেত্রে অনেক অবদান থাকে। পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন। ব্যক্তি থেকে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসতে হবে। যাতে পথশিশুরা সুন্দর ও নিরাপদ একটা আশ্রয়স্থল, খাবার, শিক্ষার ও সেবার পরিবেশ পায়। বিনামূল্যে শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণÑ পথশিশুরা যাতে অদূর ভবিষ্যতে জাতির জন্য কল্যাণকর কাজে নিয়োজিত থাকে, সেজন্য তাদের বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেই সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। আইন প্রয়োগ ও শিশু পাচার রোধÑ দেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা এবং শিশু বা মানব পাচার সংক্রান্ত যেসব আইন-কানুন রয়েছে, সেগুলো জোর পদক্ষেপে বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিবারভিত্তিক সহায়তা প্রদানÑ যে সমস্ত পথশিশুর বাবা-মা রয়েছে, তারা যেন তাদের সন্তানদের পথশিশুর জীবনপন্থা অবলম্বন না করাতে হয়, সেজন্য তাদের সরকারি বা বেসরকারি কর্তৃক বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ বা কর্মসংস্থান ব্যবস্থা করতে হবে। ব্র্যাক, আশা, অপরাজেয় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন এনজিও ইতোমধ্যে পথশিশুদের উন্নয়নে কাজ করছে। এর সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে তাদের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
আমাদের ভাবতে হবে পথশিশুরাও মানুষ। তাদেরও আমাদের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার বা চাহিদা রয়েছে। আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে, পথশিশু শুধু মানবিক সংকট নয়, এটা একটা দেশীয় ও জাতীয় সমস্যা। যদি তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে না পারে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে তারা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং এ সমস্যা নিরসনের জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সমস্যার সমাধান করতে হবে।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়