দীর্ঘ ১৫ মাস হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ চলার পর গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় প্রথম ধাপে ৪২ দিনের যুদ্ধবিরতি আরম্ভ হয়। যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর হামাস ও ইসরাইল ইতোমধ্যে ৪ ধাপে বন্দি বিনিময় করেছে। ১৮ ইসরাইলি ও কয়েকশ’ ফিলিস্তিনি এ সময়ের মধ্যে মুক্তি পেয়েছেন। শর্তানুযায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল ৩ ধাপে। এ সময়ের মধ্যে সকল জীবিত ও মৃত জিম্মিকে হামাস মুক্তি দেবে আর ইসরাইল গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। তিন ধাপের যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় বন্দি বিনিময়সহ দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় এই সমঝোতার প্রচেষ্টা চলেছিল। ১৫ জানুয়ারি কাতারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দোহায় আলোচনার পর যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন হামাস ও ইসরাইলের প্রতিনিধিরা। চুক্তি অনুযায়ী তিন ধাপে যুদ্ধবিরতিতে প্রথম ধাপের ছয় সপ্তাহে হামাস ৩৩ ইসরাইলিকে মুক্তি দেবে। বিনিময়ে ইসরাইলের কারাগার থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পাবে। গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বৃদ্ধি করা হবে এবং ইসরাইলি সৈন্যদের একাংশকে গাজা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে অন্য জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে এবং স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতি আরম্ভ হবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, লেবাননে যুদ্ধবিরতি ও ইরান দুর্বল হওয়ার পর হামাস যে ব্যাপক চাপে ছিল এবং আঞ্চলিক সমীকরণ যেভাবে বদলে গিয়েছিল এই যুদ্ধবিরতি কেবল সেটারই ফল নয়, বরং আমেরিকার দৃঢ় ও কষ্টসাধ্য কূটনীতিরও ফসল। এই যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিরোধিতা করে ইসরাইলের কট্টর ডানপন্থি জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির পদত্যাগ করেছেন। তার দল জিউইশ পাওয়ার পার্টি এটিকে ‘কলঙ্কজনক’ যুদ্ধবিরতি চুক্তি বলে অভিহিত করেছে। এদিকে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা ব্যর্থ হলে ইসরাইল হামাসের বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ শুরু করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে হুঁশিয়ারি করেছেন নেতানিয়াহু। ‘যুদ্ধবিরতি সাময়িক’ এবং ‘অভিযান এখনো শেষ হয়নি’ জানিয়ে তিনি বলেন, আবার গাজায় হামলা চালানোর অধিকার ইসরাইলের রয়েছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট উভয়ে সমর্থন করবেন। যদি আবার হামলা শুরু করি তা আরও জোরালো হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ‘আমরা মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা বদলে দিয়েছি’ জানিয়ে হামাস বর্তমানে ‘সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
গত ১৯ জানুয়ারি থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও সোমবার প্রথমবারের মতো হাজার হাজার ফিলিস্তিনি উত্তর গাজায় নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুদ্ধবিরতির প্রথম ছয় থেকে সাত সপ্তাহ সময়টা কঠিন হবে। কারণ, এই যুদ্ধ থামানোর কোনো ইচ্ছা ইসরাইলের ছিল না। তাদের এজেন্ডা ছিল গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিয়ে গাজা দখল করা। এ যুদ্ধবিরতি ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চলমান স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের অবসান ঘটিয়েছে। যুদ্ধে ইসরাইল কৌশলগতভাবে বিভিন্ন সফলতা অর্জন করলেও হামাসকে কিন্তু নির্মূল করতে পারেনি। অপরদিকে, হামাসের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলার লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা ও স্বাধীনতার ইস্যুকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে আনা, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অব্যাহত দখলদারি চালিয়ে যাওয়ায় ইসরাইলকে শাস্তি দেওয়া এবং দেশটির কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের ফেরত আনা। গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতি উপেক্ষা করে ইসরাইল ফের হামলা চালিয়েছে। দখলকৃত পশ্চিম তীরের জেনিনে ইসরাইল বড় ধরনের সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে। গাজাকে ধ্বংসের পর ইসরাইল এবার পশ্চিম তীরে নজর দিয়েছে। ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেছেন, সন্ত্রাসী অবকাঠামো তৈরি ঠেকাতে জেনিনে অন্তত ২৩টি ভবন ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে জেনিনে ভবন ধ্বংসের ঘটনাকে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘নৃশংস দৃশ্য’ বলে মন্তব্য করেছে। জেনিন ও তুলকারম শরণার্থী শিবিরে গোটা আবাসিক এলাকার ধ্বংস ঠেকাতে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি অধিবেশন ডাকার আহ্বান জানিয়েছেন। গাজায় যুদ্ধবিরতির পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু কিন্তু উভয় সংকটে পড়েছেন। কারণ, একদিকে যুদ্ধবিরতির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন থেকে ব্যাপক চাপ রয়েছে, আবার নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের একাধিক কট্টরপন্থি শরিক দল স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, গাজায় পুনরায় সামরিক অভিযান শুরু না হলে তারা সরকার থেকে সরে যাবে। ইসরাইলের বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোতরিচ বলেছেন, আমাদের এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন স্টাইলে এগোনো উচিত। আমাদের এখন প্রয়োজন গাজা দখল, অস্থায়ী ভিত্তিতে হলেও সেখানে সামরিক আইন জারি, ফিলিস্তিনিদের অন্য কোনো দেশে স্থানান্তর হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা এবং সর্বোপরি নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করা।
ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে বলেছিলেন, এর আগে হোয়াইট হাউসে এত ভালো বন্ধু ইসরাইল কখনো পায়নি। বর্তমান মেয়াদের সম্পর্কের এই ধারা তিনি অব্যাহত রাখবেন। এদিকে ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম নেতা হিসেবে নেতানিয়াহু তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বিষয়টিকে নেতানিয়াহু ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের মৈত্রী শক্তির স্মারক হিসেবে দেখছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর নেতানিয়াহু দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার প্রাক্কালে বলেন, তারা দুজন হামাসের বিরুদ্ধে বিজয়, সকল জিম্মিকে মুক্ত করে আনা এবং ইরানের সন্ত্রাসী অক্ষ মোকাবিলা নিয়ে আলোচনা করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি যুদ্ধবিরতি বিষয়ে কথা বলেছেন। গাজায় যুদ্ধবিরতি জোরদারের বিষয়ে উভয় নেতাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন। হোয়াইট হাউস এ প্রসঙ্গে জানিয়েছে, গাজা থেকে জিম্মিদের মুক্ত করতে মিসরের ভূমিকার গুরুত্ব নিয়ে দুই নেতা কথা বলেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্প শান্তি ফেরাতে পারবেন বলে নিজের আত্মবিশ^াসের কথাও জানিয়েছেন মিসরের প্রেসিডেন্ট। গত সোমবার কাতারের দোহায় সফররত তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান ও কাতারের প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। শেখ মোহাম্মদ বলেন, গাজার দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে কখন আলোচনা শুরু হবে তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। আলোচনার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কাতার হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যোগাযোগ করছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে অগ্রগতি দৃশ্যমান হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পরদিনই ট্রাম্প বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি এবং গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পন্ন করার অক্ষমতাকে কটাক্ষ করেন। ট্রাম্প বলেন, বাইডেন এটি করতে পারেননি। আর আমি যদি কোনো সময়সীমা আরোপ না করতাম এটি কখনোই সম্ভব হতো না। তবে গাজা যুদ্ধবিরতি টিকবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত নই যে, এই যুদ্ধবিরতি কতদিন টিকবে। কারণ, এটি আমাদের যুদ্ধ নয়, এটি তাদের যুদ্ধ। তাই এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে আমি আত্মবিশ^াসী নই। তিনি আরও বলেন, হামাস দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং গাজা এখন একটি বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের মতো। ট্রাম্পের এমন মন্তব্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আবারও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। ট্রাম্প গাজার ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে সরিয়ে নিয়ে গাজা উপত্যকা খালি করতে বলেছেন। গাজার বাসিন্দাদের আশ্রয় দিতে তিনি মিসর ও জর্দানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ইসরাইলের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির ট্রাম্পের এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জােিনয় বলেন, যখন বিশে^র সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই এই ধারণা উপস্থাপন করেন তখন এটি বাস্তবায়ন করা ইসরাইল সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখনই অভিবাসনকে উৎসাহিত করা উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূখণ্ড ছেড়ে যেতে বাধ্য করতে ট্রাম্পের প্রদত্ত বক্তব্যটি যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ উসকে দেওয়ার শামিল। এটা ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকারের চরম লঙ্ঘন। এমন জাতিগত নির্মূল পরিকল্পনা ইহুদি উপনিবেশ সম্প্রসারণের পথকে সুপ্রশস্ত করবে। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালীন লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। এবারও গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য করা হলে আগের মতো কালো অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, এই পরিকল্পনার মাধ্যমে ট্রাম্প দীর্ঘমেয়াদি জায়নবাদী আন্দোলনের পথেই অগ্রসর হচ্ছেন। জায়নবাদীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে ইসরাইলের উপনিবেশে পরিণত করা। এদিকে ট্রাম্পের দেওয়া ফিলিস্তিনিদের মিসর ও জর্দানে স্থানান্তরের প্রস্তাব কাতারসহ সংশ্লিষ্ট দেশ দুটি প্রত্যাখ্যান করেছে। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসও ট্রাম্পের এই আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসরাইল যে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দিতে চায় এর সঙ্গে ট্রাম্পের বক্তবের মিল রয়েছে। গাজা ভূখণ্ডের ফিলিস্তিনিরা ভবিষ্যতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে থাকতে চাইছেন। সেইসঙ্গে ইসরাইল ও হামাসের প্রতি গাজা যুদ্ধবিরতি স্থায়ী করার জন্য কাতার দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা দ্রুত শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে। কাতারের প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, যে কোনো জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতিকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি। গাজা খালি করার বিষয়ে ট্রাম্পের বক্তব্যের বিরোধিতা করে জর্দান, মিসর, সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এই ৫ আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হুসেইন আল-শেখ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে একটি যৌথ চিঠি দিয়েছেন।
ট্রাম্প ও তার জামাতা জ্যারেড কুশনার প্রায় ৮ বছর আগে ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ উন্মোচন করেছিলেন। ফিলিস্তিনিরা এটিকে সঠিকভাবেই ‘শতাব্দীর সেরা ডাকাতি’ বলে অভিহিত করেছিল। এর মূল লক্ষ্য ছিল, পশ্চিম তীরে অবৈধভাবে গড়ে তোলা ইহুদিদের বসতিগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষাকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে যাওয়া। ট্রাম্পের সেই সময়ের ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ এবং বর্তমান সময়ের ‘গাজা পুরোপুরি সাফ করে ফেলা’র মতো প্রস্তাবগুলো মূলত একই প্রকৃতির। ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের যে অপপ্রয়াস তা চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি ইসরাইলের কট্টরপন্থি নীতিগুলোকে আরও সুদৃঢ় করবে। ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের বিরুদ্ধে যাবে। ইসরাইলের গণহত্যামূলক যুদ্ধের কারণে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে প্রায় ৬১ হাজার ৭০৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন; যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। এ ঘটনায় কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি এখনো নিখোঁজ। হামলায় ১ লাখ ১১ হাজার ৫৮৮ জন আহত হয়েছেন। গাজা সরকারের তথ্য বিভাগের প্রধান সালামা মারুফ বলেন, ইসরাইলের হামলায় নিহত ৭৬ শতাংশ ফিলিস্তিনির মরদেহ উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। প্রায় ১৪ হাজার ২২২ ফিলিস্তিনি এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই যুদ্ধের কারণে গাজার বিশাল অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা সংক্রান্ত সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী গাজার ৯২ শতাংশ বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী গাজার ১৮ লাখ মানুষের জরুরি আশ্রয় ও প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি জিনিসপত্র প্রয়োজন। জাতিসংঘের ওয়বসাইটে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী গাজাজুড়ে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ প্রায় ১৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ইসরাইল-হামাস যুদ্ধবিরতির সময় ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে তারা প্রস্তুত। তবে তা করার জন্য উপত্যকাজুড়ে পদ্ধতিগত প্রবেশাধিকার প্রয়োজন। সংস্থাটির প্রধান তেদরস আধানম গেব্রেয়াসুস মনে করেন, ধ্বংসের মাত্রা, কাজের জটিলতা, সংশ্লিষ্ট সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে বিপুল চাহিদা পূরণ করা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা একটি জটিল ও চ্যালেঞ্জিং কাজ। সংস্থাটি বলছে, আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরে গাজার বিধ্বস্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুনর্গঠনে কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলার বা আরও বেশি অর্থের প্রয়োজন হতে পারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গত বছরের নভেম্বর মাসে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
গাজায় পরিচালিত এই যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরাইল গণহত্যা মামলার মুখোমুখি হয়েছে। এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে দেওয়া একটি চিঠিতে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ লিখেছেন, গাজা পুনর্গঠনে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে তিনি কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূখণ্ড থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ মহাসচিবের দৃঢ় অবস্থানের কারণে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হামাস-ইসরাইল যুদ্ধবিরতি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা এবং সংঘাতের কূটনৈতিক সমাধানে এটি সহযোগিতা করতে পারে। এ যুদ্ধবিরতি যুদ্ধের অবসান ঘটাবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে একটি টেকসই শান্তির সূচনা করবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়