ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১

বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে পাঠক বাড়ছে কি

ড. ইউসুফ খান

প্রকাশিত: ১৯:০৯, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে পাঠক বাড়ছে কি

বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বাতাসে ভেসে বেড়ায় নতুন বইয়ের গন্ধ। লেখক প্রকাশক ও পাঠক- এই তিনটি শব্দ যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটিক ভাবা যায় না। অর্থাৎ একটি আরেকটির পরিপূরক। ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের একই প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যায়। সারাদেশের লেখক, প্রকাশক ও পাঠক এবং সংস্কৃতিমনা মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে উঠে প্রাণের মেলা বইমেলা। এখানে পাঠক লেখকের মিলনই শুধু ঘটে না, বরং একটি জাতির সৃজনশীলতা ও মননশীলতার প্রতিফলন ঘটে।

লেখালেখির জগতে একটি জটিল দার্শনিক প্রশ্ন হলো, লেখককেই কী পাঠক সৃষ্টি করতে হবে? আমার মতে, এর উত্তর হলো হ্যাঁ। লেখককেই পাঠক সৃষ্টি করতে হবে। যেমন- হুমায়ূন আহমেদ তার লেখনীর মাধ্যমে এক বিশাল পাঠক গোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হন। এর জন্যই তিনি ইতিবাচক চিন্তার মননশীল লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। পাঠকের মনকে ওই লেখাটাই নাড়া দেয়, যে লেখায় সৃজনশীলতা থাকে, যে লেখা নতুন করে কিছু চিন্তার খোরাক জোগায়। নতুন করে ভাবতে শেখায়। অতীতের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। সত্যি কথা বলতে কি, বই যেমন সুখের সঙ্গী, তেমনই দুঃখের সঙ্গী। সত্য-ন্যায়ের পথপ্রদর্শক। বন্ধুর চেয়েও বই অনেক বড়। বন্ধু অনেক সময় পর হয়ে যায়। ভালো বই কখনো পর হয় না। বন্ধুর সঙ্গে বন্ধু প্রতারণা করতে পারে। ভালো বই কখনো পাঠককে প্রতারণা করে না। ভালো বই কখনো মিথ্যা তথ্য দেয় না। বরং সত্যের সন্ধান দেয়। এজন্যই বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, মানুষের জীবনে তিনটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ। তাহলো- বই, বই এবং বই।
তবে বই নির্বাচন বন্ধু নির্বাচনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। একটা বই একদল আলোকিত মানুষ তৈরি করতে পারে। আবার একটা বই একদল বিপদগামী মানুষও তৈরি করতে পারে। ভালো বই, মন্দ বইয়ের পার্থক্যটা এখানেই। ভালো বই মনের বদ্ধ দরজা খুলে দেয়। মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হতে সাহায্য করে। জীবনকে উপলব্ধি করতে হলে ভালো বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। বইয়ের মাধ্যমে আমরা মহৎ ব্যক্তিদের সান্নিধ্য লাভ করি। তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়। এমনকি মৃত লেখকদের সঙ্গেও। কথাটা অবাক হওয়ার মতো হলেও সত্যি। বিষয়টা ঠিক এরকম- আমরা যখন একজন লেখকের বই পড়ি, তখন তার অক্ষরের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তারই বক্তব্য শ্রবণ করি। আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়ি। তার মানে, রবীন্দ্রনাথ যে কথা বলছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে, আমরা তা অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করি, শ্রবণ করি। বইয়ের মাধ্যমে একাগ্রতার সঙ্গে তার উপদেশ গ্রহণ করি। তখন রবীন্দ্রনাথকে দূরের অথবা অন্য জগতের কেউ বলে মনে হয় না। মনে হয়, তাঁকে আমরা খুব কাছে থেকে দেখছি। আমাদের সঙ্গেই তিনি আছেন। অর্থাৎ আমরা তাঁর সঙ্গী হয়ে যাই। তাঁর সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে উঠি। এমনি করে বই মহান ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাদের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ করে দেয়। তাঁদের সাহচর্যে আমাদের জীবন উন্নত হয়।
শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, এটা একটা উদাহরণ মাত্র। সব মহৎ সৃষ্টিশীল লেখকের বিষয়ে ওই একই কথা। বই পড়তে পড়তে আমরা সঙ্গী হয়ে যাই এমনি অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী-মনীষীর। কবি নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, শেলী, বায়রন, কীট্স, শেক্সপীয়র, বার্ট্রান্ড রাসেল- এমন দেশ-বিদেশের অজস্র জীবিত ও মৃত জ্ঞানী-গুণীজনদের সঙ্গে। বই ছাড়া এমন শক্তি আর কার আছে? তাই একটা ভালো বই একজন মানুষ, একটা সমাজ, একটা দেশের জন্য যত বড় কল্যাণকর, একটা মন্দ বই তারচেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর।
লেখকরা যা লেখেন, প্রকাশকরা তা প্রকাশ করেন। প্রকাশকের হাতেই বইয়ের সৃষ্টির পূর্ণতা পায়। তাই লেখকের লেখা একটি বইয়ের বিষয়ে প্রকাশকের দায়িত্ব অনেক। প্রকাশককেও একজন প্রজ্ঞাবান, রুচিশীল ব্যক্তি হতে হয়। লেখক যা লিখবেন, তা-ই প্রকাশ করা একজন সুবিবেচক প্রকাশকের দায়িত্ব নয়। তাকেও একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হতে হবে। সমাজের প্রতি তারও একটা দায়বদ্ধতা আছে। অর্থাৎ লেখক সৃষ্টিতে একজন প্রকাশকের গুরুত্ব অনেক। লেখকের ভালো লেখার বই তিনি প্রকাশ করবেন আগ্রহের সঙ্গে। এতে করে লেখক উৎসাহিত হবেন। আরও ভালো ভালো লেখা তার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসবে। লেখকের সুষ্ঠু প্রতিভার বিকাশ ঘটবে। সৃষ্টি হবে নতুন মননশীল সাহিত্য। লেখক হবেন প্রতিষ্ঠিত।
ভুলে গেলে চলবে না, প্রকাশনা একটা শিল্প। প্রকাশনা ব্যবসা একটা শৈল্পিক ব্যবসা। সে হিসেবে প্রকাশকরা সবাই এক একজন শিল্পী। আগের দিনে বই প্রকাশ এত সহজ ছিল না। প্রকাশনা সংস্থার কাছে লেখক তার পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেলেই বই ছাপিয়ে দিতেন না। পাণ্ডুলিপিটি উল্টিয়ে পাল্টিয়ে ভালো করে পড়ে তারপর তারা তা বই আকারে প্রকাশ করবেন কি না, সে বিষয়ে মতামত দিতেন। একটি গল্প দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করছি।
একবার এক তরুণ কবি তার কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের কাছে গিয়ে বললেন, দুর্দান্ত কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে এসেছি। বইটি ছাপিয়ে দিন। প্রকাশক যথারীতি পাণ্ডুলিপিটি যাচাই-বাছাই করে দেখে তরুণ কবিকে বললেন, আপনি কী বিবাহিত? তরুণ উত্তরে জানালেন না, তিনি বিবাহিত নন। তিনি এটাও বললেন, এর সঙ্গে বিয়ের কী সম্পর্ক! তখন প্রকাশক বললেন, না বলছিলাম যে, বিবাহিত হলে অন্ততপক্ষে একজন পাঠক তো পাবেন।
আমরা বই পড়ি না, বই ভালোবাসি না, বইকে সমাদর করি না- এমনি ধরনের অভিযোগ আমরা শুনে থাকি। কথাটা সমর্থনযাগ্য নয়। যদি ভালো না বাসি, বইয়ের যদি পাঠক না থাকে, তাহলে প্রতি বছর এত বই ছাপা হয় কেমন করে? অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও প্রকাশকরা টিকে থাকেন কীভাবে? বছরের বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশে বিভিন্ন স্থানে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রচুর বই বিক্রি হয় সেখানে। বইয়ের পাঠকের যে অভাব নেই, এটা কি তা প্রমাণ করে না? বইমেলায় শুধু বই ছাড়া অন্যকিছুর আকর্ষণে নয়- চোখ ধাঁধানো কিংবা মন মাতানো নাচ-গান অথবা অন্য কোনো চটকদার বিনোদনের আকর্ষণে নয়, তবু মানুষ বইমেলায় প্রবেশ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে। তা কি শুধু বইয়ের আকর্ষণে নয়?
বই পড়ার সময় নেই, অথচ ড্রয়িংরুমের শেল্ফে ভালো ভালো লেখকের বই সাজিয়ে রাখেন অনেকে। কিসের জন্য? না লোকে বলবে- লোকটা ভদ্র, তার রুচি আছে। অর্থাৎ বই মানুষের সুপরিচিতি প্রদান করে, এটা তিনি বিশ্বাস করেন। তাহলে বইকে মানুষ অনাদর করে, অবহেলা করে- এ কথা কেমন করে সত্য হয়?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে বই পড়া হয়, তাকে বলা হয় পাঠ্যবই। তার মানে অন্য সব বই তাহলে কি অপাঠ্য? সেজন্যই হয়তো পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই সম্পর্কে অনেকের মধ্যে নেতিবাচক বলে একটা ধারণা আছে। অনেকে কথায় কথায় বলেও থাকেন, বাজে বই পড়ে ছেলেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েরা যাতে সে সব বই না পড়ে, সেদিকে সতর্ক নজর রাখেন। তাদের ছেলেমেয়েরাও এসব বই পড়ে গোপনে লুকিয়ে লুকিয়ে। প্রায় সময়ই অভিভাবকের ভয়ে তটস্থ থাকেন। এমনিভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের দূরে রাখা হচ্ছে। তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে উন্নত জ্ঞানের বই পড়া থেকে।
পাঠ্যবই ছাড়া বাইরের বই নিয়ে কেন আমাদের মধ্যে এত লুকোচুরি ছিল? আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা তুলে ধরছি। পাঠ্য বইয়ের ওপর স্বপন কুমার সিরিজের বই বসিয়ে দিয়ে এমন একটা ভাব করতাম, যা দেখে মা অভিভূত হয়ে যেতেন। ভাবতেন, আমার ছেলে অনেক মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করছে। মাকে ঠকানো সহজ ছিল। কিন্তু বাবার সঙ্গে এই ঠককাণ্ড করতে গিয়ে একবার ধরা পড়ে যে সাজা হয়, তা বলার মতো নয়। বাবার দেওয়া দণ্ডে স্বপন কুমার নির্বাসনে গেলেন আজীবনের জন্য।
প্রতিবছর মেলায় হাজার হাজার বই প্রকাশ পাচ্ছে, বিক্রিও হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সব বই কি সেভাবে আমাদের কাজে আসে। এসব বইয়ের সবই কী মানসম্মত হয়! তা কে নির্ধারণ করবে? এক্ষেত্রে বই প্রকাশের আগে তার মান যাচাই প্রয়োজনের সময় এসেছে। নইলে বইয়ের সংখ্যাই শুধু বাড়বে, পাঠক বাড়বে না। বরং সেসব বই কিনে পাঠকরাও প্রতারিত হবেন। তাতে তারা পুরো লেখক সমাজের ওপর আস্থা হারাতে শুরু করবেন। বিষয়টি এখনই ভেবে দেখা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি।

লেখক : চেয়ারপারসন, ব্যুরো বাংলাদেশ

×