![শাবান ও লাইলাতুল বরাত শাবান ও লাইলাতুল বরাত](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/11-2502131306.jpg)
এখন আরবি শাবান মাস। মাহে রমজানকে সফল করে তোলার জন্য শাবান মাসের বহুবিধ কর্মসূচি রয়েছে। এটি জীবন সাধনার এক বিনিসুতোর বন্ধনে আবদ্ধ একটি পিরিয়ড। মহানবী হুজুরেপুর নুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুন্দর বলেছেন, রজব মাস হলো পুণ্যের খেতে বীজ বপনের মাস, শাবান উঠতি খেতে পানি সিঞ্চন বা সরবরাহের মাস আর রমজান হলো পুণ্য ফসল ঘরে তোলার মাস। সুতরাং যে ব্যক্তি রজবে বীজ ফেলবে না, শাবানে তাতে পানি দেবে না সে ব্যক্তি কিভাবে রমজানের মাহিনায় ভালো ফসল লাভের আশা করতে পারে?
মহানবীর (সা.) উপরোক্ত বাণী থেকেই আমরা মাসগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। আমরা হযরত রাসূলে কারিমের (সা.) জীবনে আরও দেখি, তিনি এ ধারাবাহিকতা রক্ষার তাওফিক দানের জন্য প্রায়ই পরওয়ারদিগার আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া, মোনাজাত করতেন। তিনি বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক ফি রাজাবা ওয়া শাবানা ওয়া বাল্লিগনার রমজানা’- হে আল্লাহপাক। তুমি আমায় রজব ও শাবানে বরকত দাও আর রমজান পর্যন্ত পৌঁছার সৌভাগ্য দান কর।’ আমরাও যেন হুজুরে আকরাম (সা.) এর কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে এ দোয়া ও প্রত্যাশা পোষণ করি।
কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য এবং তাতে কৃতিত্ব ও বিজয় লাভের জন্য অবশ্যই কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি পর্ব পালন করতে হয়। দিতে হয় প্রয়োজনীয় মহড়া। তদ্রুপ রমজান মাসব্যাপী কৃচ্ছ্রসাধনের যে প্রতিযোগিতা, আমিত্ব বিলুপ্ত করে ইনসানিয়াত গড়ার যে প্রত্যয় তা সফল করার জন্য শাবানের আমল অনিবার্য।
হযরত রাসূলে কারিম (সা.) এ মাসে তাই রোজার অভ্যাস করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন, দান সাদকা করার জন্য বলেছেন, গুরুত্বারোপ করেছেন রাত্রি জাগরণের ওপর। রোজা রাখার তাগিদ করতে গিয়ে তিনি এরশাদ করেছেন- নাক্কু আবদা নাকুম বিসাউমি শাবান, অর্থাৎ তোমরা তোমাদের শরীরকে শাবান মাসে রোজা রেখে পাক-পবিত্র করে নাও রমজানের সিয়াম সাধনার সুবিধার জন্য। যে এ মাসে তিনটি রোজা রাখবে তার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। হযরত (সা.) নিজে এ মাসে প্রায়ই রোজা রাখতেন। আমরা পবিত্র শবেবরাতকে সামনে রেখে এ তিনটি রোজা রাখতে পারি।
রাত জাগা সম্পর্কে আঁ-হযরত (সা.) বলেন, তিনটি আওয়াজ, আল্লাহর বেশ পছন্দ। (১) মোরগের আওয়াজ। যেহেতু মোরগ প্রতুষ্যে আওয়াজ ও জিকির করে বণি আদমের ঘুম ভাঙায়, (২) কুরআন তেলাওয়াতকারীর কণ্ঠ। কারণ ওই কণ্ঠে খোদার মহিমা প্রকাশ পায়। (৩) আর ওই ব্যক্তির সুর যে ব্যক্তি শেষ রাতে আল্লাহর ধ্যানে (যখন সারা দুনিয়া ঘুমের ঘোরে অচেতন) করুণ আবেগময় চিত্তে খোদাকে ডাকে।’
তিনি আরও বলেছেন, ঘুম হলো মৃত্যুর ভাই, জান্নাতের আহালগণের মৃত্যু হয় না। পক্ষান্তরে দোযখীদের মরণও নেই জীবনও নেই। অর্থাৎ জান্নাত প্রত্যাশীরা আল্লাহর দিদারের জন্য পাগলপারা হয়ে ঘুমকে তুচ্ছজ্ঞান করে ইবাদতকে প্রধান্য দেয়। আর প্রকৃত জান্নাতবাসীদের তো মৃত্যু নেই। পক্ষান্তরে দোযখের শাস্তি ও ভয়াবহতা এত বেশি যে তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার মতো জীবনও নেই মৃত্যু হবে না। কঠিন যন্ত্রণায় দাহ হতে হবে প্রতিনিয়ত। তাই ঘুমের আধিক্য পরিহার করে আমাদের উচিত ইহ-পরকালের সামান যোগাড় করা। পবিত্র শবেবরাত উপলক্ষে আল্লাহ পাকের অগণিত প্রিয় বান্দা রাত্রি জাগরণ করেন। ইবাদত বন্দেগিতে তিলাওয়াত ও রোনাজারিতে দিবানিশি গুজরান করেন। মুনাজাতে বলেন- আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল জান্নাহ ওয়া আউযুবিকা মিনান্নার’!- কুদাওয়ান্দ কুদ্দুস। আমরা তোমার নয়নাভিরাম বেহেশতের ভিখারী আর কঠিন আযাবস্থল জাহান্নাম থেকে পানাহ কামনা করি।
এ মাস আসলেই ইসলামী সোনালি যুগের মু’মিন মুসলমানরা অধিক পুণ্যলাভের আশা ও সমাজের নিঃস্ব অসহায়দের সুবিধার কথা বিবেচনা করে দান-সদকায় বেশ তৎপর হয়ে উঠতেন। এতে গরিব মানুষ একটু সচ্ছল হয়ে সিয়ামের মাসের খরচ পোষিয়ে নিতে পারতেন। আমাদেরও এসব ঐতিহ্য বজায় রাখতে হবে একটি সামাঞ্জস্যপূর্ণ ভ্রাতৃত্বময় সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য।
এ মাসের গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব হলো পবিত্র শবেবরাত। বছরে অত্যধিক ৫টি পুণ্যময় রাতের মধ্যে এটি অন্যতম। নবী পত্নী হযরত আয়েশা (রা.) হতে একটি হাদিস বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আমি এক রাতে মহানবীকে (সা.) যথাস্থানে না পেয়ে খুঁজতে থাকি। হঠাৎ দেখি তিনি সেজদারত। কিন্তু তার দীর্ঘক্ষণ সিজদাবনত অবস্থা দেখে আমার মনে এ সন্দেহ হয় যে, হয়তো আঁ-হযরতের (সা.) প্রাণবায়ু বের হয়ে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি এসে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলী নাড়া দিলাম। ক্ষণিক পরে তিনি উঠে পড়েন এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আয়েশা! তুমি কি জান না আজ কোন রাত? আজ তো লাইলাতুন নিস মিন শাবান অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত।’
মা-সাবাতা বিস সুন্নাহর বর্ণনা থেকে জানা যায়, মহান আল্লাহ প্রত্যেক রাতেই পৃথিবীর আসমানে তাশরীফ আনেন, তার সে আগমন ঘটে রাতের শেষ তৃতীয়াংশে। তবে শাবানের ১৫ তারিখের রাতের ব্যাপারটি এর ব্যতিক্রম। সে রাতে মাগরিবের ওয়াক্ত থেকে আল্লাহর শুভাগমন ঘটে এবং তিনি ফজর পর্যন্ত রহমতের ফল্গুধারা বিতরণ করেন। আমাদের উচিত, ইবাদত বন্দেগি ও রোনাজারির মাধ্যমে এ পবিত্র রজনী অতিবাহিত করা। এমন কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া উচিত নয় যার দ্বারা রজনীটির ভাবগম্ভীর পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং মু’মিন মুসলমানদের নিরবচ্ছিন্ন ধ্যানে বিড়ম্বনার সৃষ্টি হতে পারে।
এ বিষয়ে ইসলামের প্রকৃত কনসেপ্ট কি, শবেবরাত এলে কি কি কাজ কিভাবে আঞ্জাম দিলে মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টি ও ক্ষমা অর্জন করা যায় তা আগেই জেনে নেওয়া উচিত। ইবাদতে একটু শিরক কিংবা ভ্রান্তির মিশ্রণ সমুদয় সার্থকতায় ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। নফল নামাজ, কুরআন তিলোয়াত, তাসবিহ-তাহলিল ও সব ক’টি পাঞ্জেগানা নামাজ জামায়াতের সঙ্গে আদায় করতে পারাই হলো এ রাতে একজন মু’মিনের জন্য সৌভাগ্যময় ব্যাপার। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘বারাআত রজনীতে তোমরা রাত্রি জাগরণ করবে আর পরদিন রোজা রাখবে।’
তাই এ মাহে শাবান, পবিত্র লাইলাতুল বারাআত এবং আসন্ন রহমত বরকত ও মাগফিরাতের মাস মাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় এবং এ থেকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য আমাদের ইখলাসের সঙ্গে কাজ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব
[email protected]