![পররাষ্ট্রনীতি ও সম্ভাবনার বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতি ও সম্ভাবনার বাংলাদেশ](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/11-2502121434.jpg)
গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতা। আমরা মানবাধিকার আইনসহ সব আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমাদের পক্ষ থেকে গুম বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির পক্ষরাষ্ট্র হওয়াসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পক্ষভুক্ত এমন সব আঞ্চলিক, দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সমঝোতা বাস্তবায়ন করে যাব’। ক্ষমতায় আসার পর এরই মধ্যে ৬০টির বেশি দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ইউনূস সরাসরি দেখা করেছেন। এর বাইরে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক আর তাদের বিভিন্ন সংস্থার আবাসিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করার কথা বাদ দিলাম। এসব সাক্ষাৎ সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল না। প্রায় প্রতিটিতেই কৌশলগত আলাপ হয়েছে। আলাপ হয়েছে জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের হত্যাকাণ্ডের বিচার বিষয়ে, দুর্নীতি-অনিয়ম ও বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে, বাংলাদেশে আর্থিক সহায়তাসহ বিভিন্ন সহযোগিতার বিষয়ে।
জাতিসংঘের ৯৯তম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ওঈচচঊউ চুক্তিতে সই করেছে। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি রাজনৈতিকভাবে গুম হলে ওঈচচঊউ কমিটি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। আয়নাঘর ধরনের কোনো কিছু যেন আবারও বাংলাদেশে না ঘটে, তার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখন কোনো সরকারের আমলেই আর এটি বলার সুযোগ নেই যে, কে নিখোঁজ বা কে গুম হলো, সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। জাতিসংঘ এটি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। দেশ থেকে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা এবং ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য ড. ইউনূস আলাদা কমিশন গঠন করেছেন। সুইজারল্যান্ডের কাছে এর জন্য সহযোগিতা চেয়ে সুইস রাষ্ট্রদূতকে উপদেষ্টা কার্যালয়ে আমন্ত্রণ করে এনেছেন। তার সঙ্গে এর পদ্ধতি নিয়ে আলাপও করেছেন।
ড. ইউনূস আসিয়ানের সভাপতি দেশ মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশকে আসিয়ানের সদস্য করতে চান। তা ছাড়া মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রয়েছে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং মালয়েশিয়ায় সাতটি ইউনূস সেন্টার রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটস্থ প্রতিবেশী ভারত। ইতিহাস ও ঐতিহ্যে অভিন্ন। তারপরও দুটি দেশ দুটি সত্তা। সে কারণেই সম্পূর্ণ ভারতনির্ভরতা কাম্য নয়। ভারতের প্রভাব অন্তত অর্ধেকে নামিয়ে আনা, দেশকে অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিকভাবে মুক্ত করার একটি পথ হতে পারে আসিয়ান।
যে কোনো আঞ্চলিক সহযোগিতার প্ল্যাটফর্মে যদি একটি দানব বাস করে, তাহলে সে প্ল্যাটফর্ম কাজ করে না; যে কারণে চীন, রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে কোনো আঞ্চলিক জোট করা যায়নি। এই একই কারণে সার্কও খুব একটা কাজ করবে বলে মনে হয় না। কারণ, এখানে ভারতের ভূমিকাও দানবের মতো। তাই ভারতনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে খালেদা জিয়ার সরকার ‘লুক ইস্ট’ পলিসি হাতে নিয়েছিল, যা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
চীনের সঙ্গে আমাদের ইওঈগ করিডর হওয়ার কথা ছিল গত দশকে। এটি হলে কলকাতা, ঢাকা, মিয়ানমারের মান্ডালা এবং চীনের কুনমিং সড়কপথ এবং পরে রেলপথ যুক্ত হতো। আমরা অনেক সহজে চীনে যেতে পারতাম। চীন থেকে পণ্য আনতে পারতাম। এই ভয় থেকেই ভারত ইওঈগ বাতিল করে দিয়ে নতুন প্রকল্প করেছে, যেখানে চীন, মিয়ানমার, ভারত আছে, কিন্তু বাংলাদেশকে রাখেনি। চীনের ইজও প্রকল্প তখন বঙ্গোপসাগরকেও যুক্ত করতে পারবে। এবার আর আকিয়াব দিয়ে নয়, পায়রা আর মোংলা এতে যুক্ত হতে পারবে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে আমাদের শ্রমবাজার প্রসারিত হবে। প্রযুক্তির দিক থেকে বহুপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়বে। আমাদের শিক্ষার্থীরা আসিয়ানের দেশগুলোতে পড়তে যেতে পারবে। আমাদের এখানে তারাও পড়তে আসতে পারবে।
সর্বোপরি ভারতের ‘বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে চাও তো আমার ওপর দিয়ে যাও’ নীতি বন্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশ একটি গ্লোবাল ভিলেজে প্রবেশ করবে। কিন্তু আসিয়ানে প্রবেশের পথ খুব কঠিন হবে বাংলাদেশের জন্য। আসিয়ানভুক্ত দেশ ১০টি। বোধ করি এর মধ্যে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া নিশ্চিত আমাদের পক্ষে ভোট দেবে। কারণ, দুটি দেশ থেকেই আমরা প্রচুর পরিমাণে পণ্য আমদানি করি। তারাও বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়াতে আগ্রহী। ব্রুনাইয়ের সুলতান বাংলাদেশকে পছন্দ করেন। তিনিও পক্ষে থাকবেন বলে মনে করি।
ফিলিপিন্সেরও বাংলাদেশের পক্ষে থাকার কথা। কারণ, তাদের সঙ্গেও আমাদের বাণিজ্যের আরও সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ-ফিলিপিন্স দুটিই এখন ইউএস ও চীনের বন্ধু। এখানে নিশ্চিত চার ভোট। অন্যদিকে, নিশ্চিত বিপক্ষে যেতে পারে মিয়ানমার। উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হলো ভিয়েতনাম। তারা চাইবে না আসিয়ানে চীনের বিনিয়োগে বাংলাদেশ ভাগ বসাক। অথবা, বাংলাদেশ আসিয়ানের মুক্তবাজার অর্থনীতির চুক্তিতে আসুক। ঐতিহাসিকভাবে লাওস পররাষ্ট্রীয় প্রায় সব ক্ষেত্রে ভিয়েতনামকে অনুসরণ করে। তাই লাওস বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দেবে। সম্ভবত এই তিনটি দেশের ভোট আমরা পাব না।
সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। প্রথম দুটি দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। আর থাইল্যান্ড যা বলবে কম্বোডিয়া তা-ই করবে। কিন্তু তাদের ভোট কোন্ দিকে যাবে, তা নিয়ে নিশ্চিতভাবে কোনো কিছু বলা খানিকটা কঠিনও বটে। বাংলাদেশ আসিয়ানে ঢুকলে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড দুটি দেশেরই লাভ আছে। কারণ, বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়বে বাংলাদেশের সঙ্গে। ভারত থেকে সরে আমরা অনেক বেশি আসিয়ানের দিকে যেতে পারব। থাইল্যান্ডে পর্যটক ও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক আয় হবে।
এখানে অবশ্য রাজনৈতিক ঝামেলা আছে। বাংলাদেশ কিন্তু একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ নয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ। আমাদের ভাষা, ভূগোল, সংস্কৃতি ও জাতি কিছুই মেলে না আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে। যদিও কয়েকটি দেশের সঙ্গে ধর্মীয় দিক থেকে মিল রয়েছে। এজন্য আমাদের প্রতি কিছুটা রাজনৈতিক অবিশ্বাস থাকা অস্বাভাবিক নয়। তারা যেভাবে বিশ্বকে দেখে, অবশ্যই আমরা সেভাবে দেখি না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভারতের মিল আছে। কম্বোডিয়া, লাওস, সিঙ্গাপুরের মিল নেই। ফলে, কোনো কৌশলগত সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের অবস্থান আসিয়ানের পুরো প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেবে কি না, প্রশ্নবিদ্ধ করবে কি না, সেটা একটা চিন্তার কারণ হতে পারে।
অন্যদিকে, আসিয়ান অত্যন্ত শান্ত এলাকা। এখানে বড় বড় শক্তির আধিপত্য নিয়ে হানাহানি নেই। চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কোথায় কতটুকু, তা নির্ধারিত ও স্থিতিশীল। এর বিপরীতে বাংলাদেশ নিয়ে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং কিছু ক্ষেত্রে রাশিয়ার কিছু মাথাব্যথা রয়েছে। ফলে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশকে যুক্ত করলে আসিয়ানের দ্বিধা থাকতে পারে।
এর বাইরে আরেক বড় সমস্যা ভারত। ভারত যদি সর্বতোভাবে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ফিলিপিন্সে তার প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য চাপ দেয়, তাহলে আমার মনে হয় না থাইল্যান্ড বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াবে। থাইল্যান্ডও এখন রাজনৈতিকভাবে খুব নাজুক অবস্থায় আছে। মাত্র কয়েক মাস আগে তাদেরও সরকার পতন হলো।
তাহলে কি আসিয়ানে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। আমার মনে হয় না। এই যুগ রাজনীতির না, অর্থনীতির যুগ। প্রতিটি দেশ এখন তার বাণিজ্যকে প্রাধান্য দেয়। সেখানে বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতি আর বিশাল এক বাজার আসিয়ানের জন্যও নতুন সম্ভাবনা। বাংলাদেশ সরকারের এখন অত্যন্ত ধীরগতিতে এগোনো দরকার। নতুন পরিস্থিতিতে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রকে একসঙ্গে রাজি করতে হবে, যেন তারা বাংলাদেশকে আসিয়ানে ঢোকাতে ভূমিকা রাখে।
অনেক বছর ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়ছি শুধু এই দিনটি দেখার জন্য যে, একদিন ভিসা ছাড়া ভিয়েতনামে যাব। শুল্কমুক্তভাবে ইন্দোনেশিয়ার কয়লা দেশে আসবে। লাওসের ছেলেমেয়েরা এ দেশে আসবে মেডিক্যাল ডিগ্রি নিতে। এটি হবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক স্বপ্নের দিন, মুক্তির দিন এবং আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের ছোবল থেকে মুক্ত হয়ে মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে স্বাধীন ও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে দাঁড়ানোর দিন।
বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গ বড় ধরনের একটি নন-বাইন্ডিং চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আর্জেন্ট এলএনজি। যার আওতায় বছরে ৫০ লাখ টন তরলীকৃত গ্যাস সরবরাহ করবে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির এক বিবৃতির বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে রয়টার্স। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর এলএনজি সরবরাহে দেশটির কোনো প্রতিষ্ঠানের এটিই সবচেয়ে বড় ধরনের চুক্তি। সার্বিকভাবে ড. ইউনূসের পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের জন্য সাফল্য বয়ে আনতে পারে।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান- ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন