একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য ও গৌরবোজ্জ্বল দিন, যা শুধু একটি ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি নয়, একটি জাতির আত্মপরিচয় ও স্বাধিকার চেতনার প্রতীক। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভাষার জন্য আত্মদানকারী সেই বীর শহীদদের, যাদের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাই। একুশের চেতনা স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে আজকের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জাগরণের শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভক্তির পর পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয় দুটি অংশেÑ পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান)। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ভাষা, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ও স্পষ্ট বৈষম্য দেখা দেয় ভাষার ক্ষেত্রে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন যে উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ সিদ্ধান্ত তৎক্ষণাৎ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৫৬ শতাংশ মানুষ বাংলাভাষী ছিল এবং বাংলা ছিল তাদের আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এই ভাষাগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই প্রতিবাদের সুর উঠতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ, রাজনৈতিক সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ ভাষার অধিকার রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারি ছিল সেই সময়, যখন এই প্রতিবাদ রক্তাক্ত রূপ ধারণ করে। সেই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেক বীর শহীদ হন। তাদের এই আত্মত্যাগ বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার সংগ্রামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।
একুশের এই রক্তাক্ত অধ্যায়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতি প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে যে, ভাষার অধিকার শুধু সাংস্কৃতিক স্বাতত্র্যের বিষয় নয়, এটি একটি জাতির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একুশের চেতনা ধীরে ধীরে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মূল শক্তি হয়ে ওঠে। ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা থেমে থাকেনি। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করে। এই পুরো যাত্রাপথে একুশের চেতনা ছিল মূল প্রেরণার উৎস।
একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ নয়, এটি আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা এখন বিশ্বব্যাপী ভাষাগত বৈচিত্র্য ও মাতৃভাষার গুরুত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি বাঙালি জাতির জন্য এক গর্বের বিষয়। কারণ একটি জাতির ভাষার জন্য সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ আজ বিশ্ববাসীর জন্য অনুপ্রেরণার প্রতীক।
যদিও একুশের চেতনা আমাদের ভাষার জন্য সংগ্রামের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়, তবে এটি আমাদের বর্তমান সমাজে আরও গভীর অর্থ বহন করে। একুশ আমাদের শিক্ষা দেয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করা এবং অধিকার আদায়ের জন্য দৃঢ় সংকল্প থাকা। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, আজ আমরা কতটা একুশের চেতনাকে ধারণ করছি? ভাষার জন্য জীবন দেওয়া সেই শহীদদের আত্মত্যাগ কি আমরা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারছি?
বর্তমানে আমাদের সমাজে ভাষার যথাযথ ব্যবহার এবং মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে। বাংলা ভাষা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেলেও আমাদের নিজস্ব সমাজে এর যথাযথ প্রয়োগ এবং মান রক্ষায় অনেক ঘাটতি রয়েছে। ইংরেজি ভাষার আধিপত্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাষার বিকৃতি এবং শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষার উপেক্ষা আমাদের জন্য এক বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একুশের চেতনাকে ধারণ করতে হলে প্রথমেই আমাদের নিজেদের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা এবং এর সঠিক ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে।
শুধু ভাষার সঠিক ব্যবহারের মধ্যেই একুশের চেতনা সীমাবদ্ধ নয়। একুশ আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও সজাগ থাকার আহ্বান জানায়। সমাজে অন্যায়, বৈষম্য এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোও একুশের চেতনার অন্তর্ভুক্ত। একুশ আমাদের শিক্ষা দেয়, জাতিগত, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক যেকোনো বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়া।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সংস্কৃতির প্রতিও গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। এই দিনের স্মরণে যে বইমেলা বা অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয়, এটি আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং মুক্তচিন্তার এক বিশাল উৎসব। এখানে নতুন লেখকরা তাদের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটায়, পাঠকরা নতুন বইয়ের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পান এবং সমাজের বুদ্ধিজীবীরা দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। এই মেলা একুশের চেতনার ধারক এবং বাহক হিসেবে কাজ করে।
একুশের চেতনাকে আরও বিস্তৃত করতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এর গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, শহীদদের আত্মত্যাগ এবং এই আন্দোলনের তাৎপর্য সম্পর্কে জানানো এবং বোঝানো অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই চেতনা জাগ্রত করতে হবে যে, ভাষা একটি জাতির আত্মপরিচয় এবং সংস্কৃতির প্রতীক। ভাষার সঠিক চর্চা এবং এর মর্যাদা রক্ষা করতে হবে প্রতিটি স্তরে।
একুশের চেতনা আজ আমাদের বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানের পথ দেখায়। বর্তমান বিশ্বের জটিল সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে একুশের শিক্ষা আমাদের অনুপ্রাণিত করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। ভাষা আন্দোলনের সেই আত্মত্যাগী চেতনা আমাদের আজও উদ্বুদ্ধ করে সকল প্রকার বৈষম্য, শোষণ এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।
বলা যায়, একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির অহঙ্কার, সাহস এবং সংগ্রামের প্রতীক। ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো আমাদের নিত্যদিনের জীবনে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। একুশের চেতনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কোনো জাতি তার ভাষা, সংস্কৃতি এবং পরিচয় হারিয়ে টিকে থাকতে পারে না। ভাষা শহীদদের রক্তে রাঙানো এই দিন আমাদের অনুপ্রাণিত করুক। আমাদের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে। একুশের চেতনা বাঙালির হৃদয়ে চির জাগ্রত থাকুক। ভাষার জন্য সেই আত্মত্যাগের কথা কখনো না ভুলে আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ুক এই গৌরবময় ইতিহাস।
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ