ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক ॥ দ্বিধা-অনিশ্চয়তা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত

সাদিয়া সুলতানা রিমি

প্রকাশিত: ২১:৪০, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক ॥ দ্বিধা-অনিশ্চয়তা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অনিশ্চয়তা ও দ্বিধার মধ্য দিয়ে গেলেও, বর্তমান কূটনৈতিক কার্যক্রমে তা কাটিয়ে ওঠার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি খাতে সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।

তবে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও উভয় দেশই সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে আগ্রহী। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষ সখ্যের পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্পর্কটাও ছিল বেশ ঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের পর বাংলাদেশ ও চীনের ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই বেড়েছে। দুই সরকারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) হৃদ্যতার বিষয়টিও গোপন ছিল না।

এমন পটভূমিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা নিয়ে চীনের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা ও অনিশ্চয়তা ছিল। বাংলাদেশে চলমান বৃহদায়তন প্রকল্পে যুক্ত নিজের নাগরিকদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল চীন।

অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের চীন সফরের মধ্য দিয়ে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক নিয়ে দ্বিধা, অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগ অনেকটা কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সরাসরি বলেছেন, তাঁদের প্রতিবেশী কূটনীতির ‘গুরুত্বপূর্ণ স্থানে’ আছে বাংলাদেশ।

আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধা থাকবে বেজিংয়ের। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভবিষ্যৎ-মুখী দিক থেকে বিবেচনা করলে তৌহিদ হোসেনের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরটিকে ঢাকা-বেজিং সম্পর্কের অনিশ্চয়তা সরিয়ে নতুন মাত্রা যোগ বলা যেতে পারে। এ সফরে বাস্তবসম্মত কিছু পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য
বাংলাদেশের জন্য চীন অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার। চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম আমদানি উৎস এবং বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান উৎস। ২০২১ সালের পর থেকে চীনের উন্নয়ন সহায়তার গতি কিছুটা কমে গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে উভয় দেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

চীন বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে বিশাল বিনিয়োগ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ, পায়রা সমুদ্রবন্দর, কর্ণফুলী টানেল, এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চীন ৯৭% বাংলাদেশী পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ইতিবাচক দিক।

তবে বাংলাদেশকে চীনের ঋণ কূটনীতি (Debt Diplomacy) সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। শ্রীলঙ্কার মতো ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি এড়াতে বাংলাদেশকে স্বচ্ছ নীতিতে এগোতে হবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর জন্য চীন সমরাস্ত্র ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে। বর্তমানে বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জামের একটি বড় অংশই চীন থেকে সরবরাহ করা হয়। চীন থেকে বাংলাদেশ যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, ফাইটার জেট, ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করেছে।

বাংলাদেশ-চীন প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সফর ও চুক্তিগুলো এই সম্পর্ককে আরও গভীর করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

প্রযুক্তি ও অবকাঠামো উন্নয়ন
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি ও অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের সহায়তা উল্লেখযোগ্য। চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় বাংলাদেশ ডিজিটাল রূপান্তর বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করছে। ৫জি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন, স্মার্ট সিটি প্রকল্প, এবং আধুনিক বিদ্যুৎ অবকাঠামো তৈরিতে চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে। চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যেমন হুয়াওয়ে ও জেডটিই বাংলাদেশের টেলিকম খাতে বড় অবদান রাখছে।

তবে তথ্য নিরাপত্তা এবং সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলো চীনের প্রযুক্তি ব্যবহারে কিছু নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা বাংলাদেশকেও বিবেচনায় নিতে হবে।

রোহিঙ্গা সংকটে চীনের ভূমিকা
বাংলাদেশের জন্য অন্যতম প্রধান কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন। এ ক্ষেত্রে চীন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করলেও এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে আরও সক্রিয় কূটনৈতিক পদক্ষেপ আশা করে, যাতে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে রাজি হয়।

চীন এই ইস্যুতে কৌশলগতভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখলেও বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এ বিষয়ে আরও জোরালো ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও বাংলাদেশে চীনের কৌশল
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ওপর আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) বাংলাদেশ-চীন কৌশলগত সম্পর্ককে প্রভাবিত করছে।

বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত চীনের BRI প্রকল্পে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত না হলেও, চীনের সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়নে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে সতর্ক এবং বাংলাদেশকে তাদের কৌশলগত অক্ষের অংশ করতে চায়। বাংলাদেশকে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে।

নতুন মাত্রা দেবে স্বাস্থ্যসেবা
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানছাও ও চীনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থার (সিডকা) চেয়ারম্যান লুয়ো ঝাউহুইয়ের সঙ্গে তৌহিদ হোসেনের আলোচনায় স্বাস্থ্যসেবায় নতুন সহায়তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঢাকার পূর্বাচলে এক হাজার শয্যার বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবকে চীন স্বাগত জানিয়েছে। চীনের অর্থায়নে দুই দেশের মধ্যে প্রথম মৈত্রী হাসপাতালটি পরিচালিত হবে চীনা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে। যেহেতু নতুন হাসপাতাল নির্মাণে কয়েক বছর লাগবে, আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও লোকজনের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কুনমিংয়ের অন্তত চারটি হাসপাতাল বাংলাদেশের নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে অনুরোধ জানায় ঢাকা।

চীন এ অনুরোধ রাখার কথা এ সফরেই জানিয়েছে। প্রয়োজন হলে কুনমিংয়ের পাশাপাশি চেংদুতে বাংলাদেশের রোগীদের জন্য বিশেষায়িত কিছু হাসপাতালে সেবা দেওয়ার আশ্বাসও চীন দিয়েছে।

বাংলাদেশে কারখানা স্থানান্তর
গত সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশে শিল্পকারখানা স্থানান্তরের কথা বলছে চীন। এবারের সফরেও প্রসঙ্গটি গুরুত্ব পেয়েছে। তৌহিদ হোসেন এর ধারাবাহিকতায় সাংহাইয়ে একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি, রোবোটিকস ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা দেখতে যান।

সাংহাইয়ের বণিক সমিতির সঙ্গেও এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বেইজিংয়ে তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে আলোচনায় সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানছাও বলেছেন, চীনের কারখানা স্থানান্তর করতেই হবে। এ প্রসঙ্গে চীন থেকে ভিয়েতনামে কারখানা সরিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে।

চীনের নেতারা বাংলাদেশকে তাঁদের কারখানা স্থানান্তরের জন্য বেশ উপযুক্ত মনে করছেন। কারণ বাংলাদেশ থেকে পণ্য উৎপাদন করে অন্য দেশে রপ্তানির সুবিধা এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রণোদনার মতো উপাদানগুলো চীনের জন্য সহায়ক হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিধা ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক একটি ইতিবাচক পথে এগোচ্ছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের অবদান বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

তবে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে স্বচ্ছতা, কৌশলগত ভারসাম্য এবং জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আরও গভীর হতে পারে। তবে এর জন্য কূটনৈতিকভাবে সতর্কতা ও বাস্তবমুখী নীতির প্রয়োজন।

শিক্ষার্থী,  জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

কুতুবে রব্বানী

×