ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০২৫, ২৭ ফাল্গুন ১৪৩১

বৈশ্বিক উন্নয়নে প্রযুক্তির ভূমিকা

মো. জাহিদুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৫১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বৈশ্বিক উন্নয়নে প্রযুক্তির ভূমিকা

বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতিকে তথ্যপ্রযুক্তির অর্থনীতি

বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতিকে তথ্যপ্রযুক্তির অর্থনীতিও বলা হয়ে থাকে। কারণ, তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা একই তথ্য-সূত্রে গ্রথিত। বিশ্বের প্রধান প্রধান অর্থনীতির দিকে তাকালে তা খুব সহজেই অনুধাবন করা যায়। আজকের অর্থনীতির বিশ্ব প্রযুক্তিকে অস্বীকার করে নয়। বরং একে সঙ্গে নিয়েই দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।

পৃথিবীর প্রতিটি দেশ এই সত্য অনুধাবন করতে পেরেছে যে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন দেশ প্রযুক্তিকে আরও সহজলভ্য করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্তার নতুন অর্থনীতির ধারণা সূচনা করেছে। বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ প্রযুক্তির নতুন অর্থনীতির ধারণার বিকাশ ঘটে ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের উদ্ভাবনের মাধ্যমে। এটি বিশ্বজগৎকে এনেছে হাতের মুঠোয়।

নতুন ব্যবসা এবং লাখ লাখ নতুন চাকরি তৈরি হয়েছে এবং একবিংশ শতাব্দীতে একটি টেকসই বৈশ্বিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন একদিনে বিশ্বে প্রায় ২০ হাজার ৭০০ কোটি ই-মেইল পাঠানো হয়। গুগলে ৪২০ কোটির বেশি নানা বিষয়ে খোঁজা হয়। 
এক যুগ আগেও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনগুলো ছিল অকল্পনীয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষেরই এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি অঙ্গাঙ্গিভাবে সংযুক্ত থেকে বিশ্ববাসীকে প্রতিনিয়তই তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখাচ্ছে। ফলে এক উদ্ভাবক বা আবিষ্কারক ছাড়া বিশ্বের বাদবাকি মানুষ আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময় মেনে নিচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির একেকটি উদ্ভাবন ও উৎকর্ষ মানুষের কল্পনাকেও যেন ছাড়িয়ে যেতে বসেছে।

প্রযুক্তির এই অকল্পনীয় নিত্য উৎকর্ষ দাক্ষিণ্যে পুরো পৃথিবীই এখন গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের নিত্যনতুন আবিষ্কারে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে আমাদের জগৎ। প্রযুক্তির উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে বিশ্ব এর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে গতানুগতিকতা। পরিবর্তন ঘটছে মানুষের জীবনধারায়ও। মানুষের জীবন সহজ, আরামদায়ক ও নিরাপদ করতে প্রযুক্তি অবদান রাখছে বড় মাত্রায়। একেকটি নতুন আবিষ্কার আসে আর বাতিল হয়ে যায় পুরনো প্রযুক্তি।

এখন হাতে একটি স্মার্টফোন থাকলে ঘড়ি, টর্চলাইট, পোস্ট অফিস, মানি অর্ডারের আয়োজন, এমনকি রেডিও-টিভিরও দরকার হয় না। বিশ্বব্যাপী ষোলোভুজের মতো বিচিত্র ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন। এর সঙ্গে সহায়ক হিসেবে যুক্ত হয়েছে আরেক বিস্ময়কর প্রযুক্তি, যার নাম ইন্টারনেট। এর ফলে বর্তমানে জীবনের মুখ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে প্রযুক্তি।

বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত আধুনিক প্রযুক্তির খোঁজ করে চলেছেন। মহাকাশজুড়ে হাজার হাজার স্যাটেলাইট পৃথিবীর দৃশ্যপট বদলে দেওয়ার অন্যতম এক নেপথ্য নায়ক। শুধু কম্পিউটার নয়, ল্যাপটপ, আইপড, ট্যাব, অ্যাপল, অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুকের মোবাইল অ্যাপ, রোবট, ড্রোন, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইনে কেনাকাটা, রাইড, সর্বাধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, ফিসিং প্রযুক্তিসহ বহু অভিনব প্রযুক্তি বিপ্লব সৃষ্টি করে চলেছে।

দিন দিন ব্যাপক হারে বাড়ছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের জনপ্রিয়তা। প্রযুক্তির জোয়ারে ভাসছে আজকের প্রজন্ম। অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে প্রযুক্তির সম্প্রসারণ হচ্ছে ব্যাপক হারে। আগামীতে এই গতি আরও ত্বরান্বিত হবে। তখন পৃথিবীর চেহারা বদলে যাবে আধুনিক প্রযুক্তির জাদুকরি ছোঁয়ায়। 
প্রজন্মের চোখ এখন অনলাইনে। বর্তমানে বিশ্বে পাঁচশ’ কোটির অধিক স্মার্টফোন ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১০ সালে বিশ্বে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১৩০ কোটি। ২০১৯ সালে ওই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭২০ কোটিতে। বিশ্বের কয়েকশ’ কোটি মানুষকে একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত করে আধুনিক তথ্যভিত্তিক সমাজের স্তম্ভ হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট। বর্তমানে প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল অর্থনীতির কর্মসংস্থানের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

বিশেষ করে আইটি সেক্টরে এর রয়েছে ব্যাপক সাফল্য। দিন দিন দ্রুতগতিতে বাড়ছে দক্ষ পেশাদারদের চাহিদা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য তৈরি হতে শুরু করেছে বিশ্ব। এই বিপ্লবের মাধ্যমে সবাই নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে বিশ্বের সব রাষ্ট্রই বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নিয়ে যাচাই-বাছাই ও প্রায়োগির দিক নিয়ে বিস্তর গবেষণা করছে। তাই এই সময়কে বলা হয়ে থাকে তথ্য ও প্রযুক্তির বিপ্লবের যুগ।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বৈশ্বিক শ্রমবাজার, ভবিষ্যতের কাজকর্মের ধরন, আয়ের অসমতা, ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের কাঠামোকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছে। এ প্রভাবের ফলে পাল্টে যাচ্ছে আধুনিক বিশ্বের সবকিছু। যার সঙ্গে পুরোপুরিভাবে মিশে আছে ভবিষ্যৎ দৃঢ়তা। এরই ফলে উল্লিখিত পরিবর্তনে মানুষের জীবন মান আরও উন্নত হবে।

এর ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষের আয় বাড়বে এবং অর্থনৈতিক কাঠামো আরও দৃঢ়ভাবে বিস্তার লাভ করবে। বিশেষ করে মানুষের মাঝে দূরত্ব কমে গিয়ে তৈরি হবে একটি অধিক শক্তিশালী অর্থনীতি সমৃদ্ধ গ্লোবাল ভিলেজ। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এআইওটি। এই এআইওটি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ইন্টারনেট অব থিংসয়ের (আইওটি) মধ্যে সুসম্পর্কের ফল।

অর্থাৎ এআই (অও) + আইওটি (ওড়ঞ) = এআইওটি (অওড়ঞ)। প্রযুক্তির এই সুবিস্তীর্ণ উৎকর্ষকে কাজে লাগিয়ে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হবে শিল্প-অর্থনীতির নানা ক্ষেত্র। 
আধুনিক বিশ্বে নিঃসন্দেহে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি দিকের ওপর এক বিশাল প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে সামাজিক কাজের প্রতিটি স্তরে প্রযুক্তি পরিবর্তনের জন্য একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নেও প্রযুক্তির এই প্রভাব ব্যতিক্রম নয়। অর্থনীতির প্রযুক্তি কাজের প্রক্রিয়া, উৎপাদন পদ্ধতি এবং খরচের ধরনগুলোকে পুনর্নির্মাণ করছে।

প্রযুক্তি কেবল উদ্ভাবনকে চালিত করে না এবং বৃদ্ধির সুযোগগুলোকে উৎসাহিত করে না, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ঐতিহ্যগত মডেলগুলোর চ্যালেঞ্জও উপস্থাপন করে। প্রযুক্তির অগ্রগতি ডিজিটাল অর্থনীতির দ্রুত উত্থানকে চালিত করেছে অত্যন্ত সুগঠিত এবং পরিকল্পিতভাবে। বর্তমান অর্থনৈতিক প্রযুক্তির যুগে ব্যবসা ঘটে প্রধানত অনলাইনে। এ ছাড়াও অর্থনৈতিক কার্যকলাপের জন্য নতুন পথ খুলে দেওয়ার পাশাপাশি ব্যবসাগুলোকে বিশ্বব্যাপী বাজার এবং গ্রাহকদের কাছে সহজে পৌঁছাতে সক্ষম করে তোলে।

প্রযুক্তি এবং মানবতার মধ্যে বিকশিত সংযোগ আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করেছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। এটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে, প্রযুক্তি দেশ, অঞ্চল এবং শহরগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালক। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আরও ভালো পণ্য এবং পরিষেবাগুলোর আরও দক্ষ উৎপাদনের অনুমতি দেয়। মূলত এর ওপর সমৃদ্ধি নির্ভর করে থাকে প্রতিটি দেশ ও বিশ্বের।

লেখক : নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

×