![ডিপসিক- চ্যাটবট কিন্তু সুরক্ষিত নয় ডিপসিক- চ্যাটবট কিন্তু সুরক্ষিত নয়](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/chn-1-2502111449.jpg)
ডিপসিক- চ্যাটবট
চ্যাটজিপিটি বর্তমান সময়ে খুবই আলোচিত বিষয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মার্কিন গবেষণা সংস্থা ওপেনএআইয়ের তৈরি চ্যাটবটের নাম চ্যাটজিপিটি (চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার)। এটি একটি অত্যাধুনিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ এআই মডেল, যা মানুষের মতো টেক্সট তৈরি করতে সক্ষম। ব্যবহারকারীর যে কোনো প্রশ্নের উত্তর খুব গঠনমূলক, সহজ, নির্ভুল এবং যুক্তিযুক্তভাবে প্রদর্শন করতে পারে।
ফলে, ব্যবহারকারীর বুঝতে সুবিধা হয় এবং কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ অর্থাৎ বিজ্ঞাপন ছাড়াই কাজ করে এটি। এই চ্যাটবট কবিতা, পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর, অর্থনীতি-রসায়ন থেকে শুরু করে যে কোনো জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। এ ছাড়া যে কোনো গল্প, স্ক্রিপ্ট, গান ইত্যাদির মতো সৃজনশীল কাজ তৈরি করা এর জন্য এক মুহূর্তের বিষয়। এটি গ্রোগ্রামিং করতে পারে এবং প্রোগ্রামিংয়ের ভুল শুধরে দিতে পারে।
তা ছাড়া ভার্চুয়াল সহকারী এবং ভাষা অনুবাদ সিস্টেমে এটি দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেখায়। পাশাপাশি গবেষণার ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে চ্যাটজিপিটি। ২০২২ সালের নভেম্বরে এই চ্যাটবট বাজারে আসার পর থেকে রীতিমতো ঘুম হারাম করে দেয় গুগলের, প্রযুক্তিপ্রেমীদের। কিন্তু সম্প্রতি চ্যাটজিপিটি এবং এ ধরনের অন্য বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর এআই মডেলগুলোকে পেছনে ফেলে প্রযুক্তি বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে চীনের হ্যাংঝুনির্ভর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের তৈরি ‘ডিপসিক’ এআই মডেল ‘আর১’।
এর সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো কম অর্থ (মাত্র ৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার) ও সীমিত সম্পদ দিয়ে দারুণ সাফল্য এনেছে কোম্পানিটি। অথচ চ্যাটজিপিটিসহ অন্য মডেলগুলো তৈরিতে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে ওপেনএআই। ডিপসিক-আর১ এপিআইয়ের ১ মিলিয়ন টোকেনের (প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার শব্দ) দাম শুরু হয় মাত্র শূন্য দশমিক ১৪ ডলার থেকে।
অন্যদিকে একই পরিমাণ টোকেনের জন্য ৭ দশমিক ৫ ডলার চার্জ করে ওপেনএআই। এত কম মূল্যে এবং ব্যাপক সুবিধা সংবলিত ডিপসিক-আর১ পুরো মডেলটিকে ওপেন সোর্স হিসেবে প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। অর্থাৎ যে কোনো ব্যবহারকারী ডিপসিক-আর১ মডেলটি বিনা মূল্যে ডাউনলোড করে নিজেদের ডিভাইসে ইচ্ছামতো চালাতে পারে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের নভেম্বরে ওপেনএআই ‘চ্যাটজিপিটি’ লঞ্চ করার পর থেকে মার্কিন কোম্পানিগুলোই এআইয়ের দৌড়ে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। তবে গুগলের ‘জেমিনাই’, মেটার ‘লামা’, মাইক্রোসফটের ‘কোপাইলট’, অ্যানথ্রপিকের ‘ক্লড’সহ কিছু উচ্চ কার্যকারিতা সম্পন্ন এআই মডেল বিশ্ববাজারে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে কাজ করছে গত আড়াই বছর ধরে।
আর এই দৌড়ে যেন চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ধরতে না পারে, সেজন্য ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাইডেন প্রশাসন ‘এনভিডিয়া’সহ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে এআই নির্মাণে প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক চিপগুলো চীনে রপ্তানি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। শুধু তাই নয়, চীনে উন্নত চিপের সরবরাহ সীমিত করার জন্য অন্য দেশগুলোর মাধ্যমেও চিপ কেনার প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এত নিষেধাজ্ঞা থাকায় মাত্র ২ হাজার এনভিডিয়ার এইচ ৮০০ চিপ ব্যবহার করেছে ডিপসিক। অথচ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এআই কোম্পানিগুলো কমপক্ষে ১৬ হাজারেরও বেশি চিপের সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করেছে। এতে প্রমাণিত যে, চীনের ফার্মগুলো প্রয়োজনীয় পরিমাণ চিপ ঠিকই সংগ্রহ করেছে অথবা সংখ্যায় কম থাকলেও তা কাটিয়ে ওঠার মতো সক্ষমতা অর্জন করেছে।
এমনকি ডিপসিকে ব্যবহৃত এইচ৮০০ চিপও ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর আর চীনে রপ্তানি করেনি যুক্তরাষ্ট্র। এর মানে, যুক্তরাষ্ট্রের এত সব অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আসলে খুব একটা কাজে আসেনি, দমাতে পারেনি চীনা প্রযুক্তিদের। এসব নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করেই ডিপসিক দক্ষিণ-পূর্ব চীনের হাংঝুত শহরে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে যাত্রা শুরু করে এবং জনপ্রিয় এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ছাড়ে ওই বছরের ১০ জানুয়ারি।
বিশ্লেষকদের মতে, ওপেন-সোর্সভিত্তিক এআই মডেলটির চ্যাটবট অ্যাপ অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে উন্মুক্তের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীনসহ কয়েকটি দেশে চ্যাটজিপিটির তুলনায় বেশিবার (২৬ লাখ) ডাউনলোড হয়। কোনো অ্যাপ কি পরিমাণ জনপ্রিয় তার বড় প্রমাণ এটি। অথচ ওপেনএআই যাত্রা শুরু করেছিল প্রায় ১০ বছর আগে।
সে সময় তাদের সাড়ে ৪ হাজার কর্মী ছিল, ফান্ডিং তুলেছিল তারা প্রায় ৬৬০ কোটি টাকার। আর ডিপসিক যাত্রা করেছে মাত্র ২ বছর আগে, তাদের কর্মী দুইশ’রও কম। এই স্বল্পসংখ্যক কর্মীর সহায়তায় অল্প কদিনেই প্রমাণ করেছে যে, এটি শক্তভাবেই পাল্লা দিতে এসেছে প্রযুক্তি বিশ্বে।
চীনের প্রযুক্তিগত এই দৌড় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের বিষয়। বলা যেতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকনভ্যালিসহ এআই দুনিয়াকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে চীনের তৈরি ডিপসিক। কম খরচের ডিপসিক বাজারে আসলে গত ২৭ জানুয়ারি এশিয়ার অর্থ-বাজারকে অস্থির করে দেয়। যার ফলে, শক্তিশালী চিপ তৈরির জন্য পরিচিত মার্কিন কোম্পানি এনভিডিয়ারের শেয়ারবাজারে মারাত্মক দরপতন (১৭ শতাংশ) ঘটে।
অর্থাৎ গুগল এবং ওপেনএআইয়ের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই যে এসেছে ডিপসিক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এরই মধ্যে চীনা (বেজিং) মালিকানাধীন আলিবাবা ‘কুয়েন ২.৫’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলের অপর একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছে, যা এই মুহূর্তে অত্যন্ত প্রশংসিত ডিপসিককেও ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করেছে সংস্থাটি। এ যেন প্রযুক্তির এক নতুন শীতল যুদ্ধ।
তবে যুদ্ধে যে-ই জিতুক, গোটা বিশ্ব এবং মানুষের অগ্রগতি হবে, এমনটাই আশা প্রযুক্তিবিদদের। তবে, বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এআই মডেলের তুলনায় কম খরচে চীনের এআই মডেলের উত্থান নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এর ফলে, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের এআই খাতে বিনিয়োগের ধারা বদলে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের তত্ত্বাবধান ছাড়াই ডিপসিকের মতো ওপেন-সোর্স এআই বিকশিত হওয়ার সক্ষমতা মানুষের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এমনকি ভবিষ্যতে দুর্বৃত্ত এআই তৈরির আশঙ্কাও রয়েছে। ইতোমধ্যেই আইফোন ও আইপ্যাডের জন্য তৈরি ডিপসিক চ্যাটবট অ্যাপে গুরুতর নিরাপত্তাত্রুটির সন্ধান পেয়েছে সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান নাওসিকিউর। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, ডিপসিক চ্যাটবট নিরাপত্তাসংক্রান্ত সর্বোচ্চ মানদণ্ড অনুসরণ করছে না এবং তাদের ব্যবহারকারীদের তথ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে।
আইওএসের জন্য তৈরি ডিপসিক অ্যাপটি অ্যাপ নিবন্ধন ও যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরাসরি ইন্টারনেটে পাঠাচ্ছে, যা কোনো এনক্রিপশন পদ্ধতির মাধ্যমে সুরক্ষিত নয়। অ্যাপটির এনক্রিপশন ব্যবস্থায়ও একাধিক গুরুতর ত্রুটি রয়েছে। এসব ত্রুটির কারণে ব্যবহারকারীদের তথ্য সহজেই জানতে পারে সাইবার অপরাধীরা।
ডিপসিক তার জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চ্যাটবট ওপেন সোর্স তৈরি করেছে। এর মানে হলো, এর কোডটি ব্যবহার, সংশোধন ও দেখার জন্য উন্মুক্ত এবং এর সোর্স কোড, ডিজাইন ও ডকুমেন্টস অ্যাক্সেস এবং ব্যবহার করার অনুমতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কোম্পানিটি চীনের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তরুণ এআই গবেষকদের এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান ক্ষেত্রের বাইরে থেকেও নিয়োগ করেছে এটির মডেলের জ্ঞান ও ক্ষমতাকে বৈচিত্র্যময় করার জন্য।
বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য আনতে পারেনি। তাই বলে সবই বিফলে গেছে, এমনটিও বলা যাবে না। তবে বিষয়গুলো নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে সামনে রেখে।
নিশ্চয়ই ডিপসিকের সমান্তরালে হাজারো স্টার্ট আপ হারিয়ে গেছে, সফল হতে পারেনি অনেকে। কিন্তু যে দুই একটা দাঁড়িয়ে গেছে, তাদের মধ্যে ডিপসিক অন্যতম। এই একটির অর্জিত অর্থ দিয়েই লাখ লাখ মিলিয়ন ডলার আয় হবে, কর্মসংস্থান হবে হাজার হাজার তরুণের। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের এ রকম স্টার্টআপ তৈরির জন্য সরকারের উচিত বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করা। কারণ, আজকের শিক্ষার্থীর হাতেই আগামীর বাংলাদেশ।
তাই শিক্ষার্থী স্টার্টআপের মাধ্যমে চেষ্টা করে কিছু অর্জন করতে পারলেই দেশের প্রযুক্তি ইনফ্রাস্ট্রাকচার মজবুত হবে। তখন অন্যের প্রতিষ্ঠানে চাকরি না করে নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করবে। আর কোনোভাবে একটি স্টার্টআপ যদি দাঁড়িয়ে যায়, তাহলেই বিশ্ব প্রতিযোগিতায় শামিল হবে বাংলাদেশের নাম।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়