ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১

একুশের বইমেলায় প্রমথ চৌধুরী এবং সৈয়দ মুজতবা আলী

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

একুশের বইমেলায় প্রমথ চৌধুরী এবং সৈয়দ মুজতবা আলী

প্রমথ চৌধুরী ও সৈয়দ মুজতবা আলী

প্রমথ চৌধুরী ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘বই পড়ার অভ্যাসটা যে বদঅভ্যাস নয় এ কথাটা সমাজকে এ যুগে মাঝে মাঝে স্মরণ করিয়ে দেওয়া আবশ্যক।’
আর সৈয়দ মুজতবা আলী ‘বই কেনা’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলে হয়নি।’ 
সম্প্রতি এক ‘বিশেষ যানে’ তাঁরা দুজন অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসেছিলেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যের আলাপচারিতার কিছু অংশ এখানে দেয়া হলো- 
প্রমথ চৌধুরী : কি হে সৈয়দ, খুব তো লিখেছিলে বই কিনে কেউ কখনো দেউলে হয়নি। এখন দ্যাখো বইয়ের দাম- এ দামে নিম্ন আয়ের কেউ সত্যিই কিনতে শুরু করলে দেউলে হতে তার বাকি থাকবে?
সৈয়দ মুজতবা আলী : দামের কথা বলবেন না মহাশয়, আমার জন্মভূমির মানুষদের হাতে এখন প্রচুর অর্থ। বই মেলায় যারা আসে এ দামে বই কেনার সামর্থ্য তাদের আছে, আমি নিশ্চিত। সুতরাং আমি আমার আগের সিদ্ধান্তে অটল। তবে ভাবনা এখন অন্য বিষয়ে। এখন চাইলেও অনেকের পক্ষে বই কেনা সম্ভব নয়।
প্র : কেন, সম্ভব নয় কেন?
মু : কারণ বই বলতে যা বোঝায় ঝকঝকে মোড়কে তার আকণ্ঠ উপস্থিতি চিত্ত হরণ করলেও চিত্তকে সমৃদ্ধ করার মতো বই হাতেগোনা। একটু ঘেঁটে দেখলে আপনিও আমার সঙ্গে একমত হবেন। 
প্র : হ্যাঁ, এ তুমি ঠিকই বলেছ, যেটুকু দেখেছি তাতেই মনে হচ্ছে এ দেশে এখন পাঠকের চেয়ে লেখকের সংখ্যা বেশি। প্রচুর বই প্রকাশ পাচ্ছে। 
মু: অর্থাৎ পড়ার অভ্যাস গড়ে না উঠলেও লেখক গজিয়েছেন প্রচুর। অবস্থা খানিক উদ্ভটই মনে হচ্ছে। চিরকাল শুনে এসেছি লিখতে হলে আগে পড়তে হবে। এখন দেখছি পড়া ছাড়াই গাদা গাদা বইয়ের লেখক হওয়া যায়।
প্র : আমার মনে হয় বইয়ের মালিক হওয়া নিয়ে লোকদের মধ্যে এক ধরনের অবসেশন তৈরি হয়েছে। যার সামর্থ্য আছে সেই দু’খানা বই লিখে ছাপিয়ে ফেলছে। টাকাটা ভালো একখানা বই কেনার পেছনে খরচ করলে অন্তত নিজের উপকার হতো। ছাপা হরফে এসব আবর্জনা কার কি উপকারে আসছে আমার বোধগম্য হচ্ছে না, তোমার হচ্ছে?
মু : না মহাশয় আমারও হচ্ছে না।
প্র : তুমি বলেছিলে, ‘প্রকৃত মানুষ জ্ঞানের বাহন পুস্তক যোগাড় করার জন্য অকাতরে অর্থব্যয় করে। একমাত্র বাংলাদেশে ছাড়া।’ বড় দুঃখেই বলেছিলে, হে। তবে তার চেয়েও দুঃখের সম্ভবত এই যে, অবস্থাটা এখনো প্রায় আগের মতোই আছে। বলা যেতে পারে, খানিক উল্টে গেছে। জ্ঞানার্জনের জন্য পুস্তক কেনা বা পড়া নয় বরং নিজেকে জ্ঞানী প্রমাণ করার জন্য পুস্তকের লেখক বা মালিক হতে অকাতরে অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আচ্ছা, তোমার সেই আরব প-িতের গল্পটা যেন কি?
মু : যদ্দুর মনে পড়ে গল্পটা ছিল এরকম ‘ধনীরা বলে, পয়সা কামানো দুনিয়াতে সবচেয়ে কঠিন কর্ম, কিন্তু জ্ঞানীরা বলেন, না জ্ঞানার্জন সবচেয়ে শক্ত কাজ। এখন প্রশ্ন কার দাবিটা ঠিক, ধনীর না জ্ঞানীর? আমি নিজে জ্ঞানের সন্ধানে ফিরি, কাজেই আমার পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া কঠিন। তবে একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি, সেইটে আমি বিচক্ষণ জনের চক্ষু-গোচর করতে চাই। ধনীর মেহন্নতের ফল হলো টাকা। সে ফল যদি কেউ জ্ঞানীর হাতে তুলে দেয়, তবে তিনি সেটা পরমানন্দে কাজে লাগান এবং শুধু তাই নয়, অধিকাংশ সময়েই দেখা যায়, জ্ঞানীরা পয়সা পেলে খরচ করতে পারেন ধনীদের চেয়ে অনেক ভালো পথে, ঢের উত্তম পদ্ধতিতে। পক্ষান্তরে, জ্ঞানচর্চার ফল সঞ্চিত থাকে পুস্তকরাজিতে। এবং সে ফল ধনীদের হাতে গায়ে পড়ে তুলে ধরলেও তারা তার ব্যবহার করতে জানে না। বই পড়তে পারে না।’
প্র : এখন প্রযুক্তি হাতের মুঠোয় আসায় বিষয়টা কি দাঁড়াচ্ছে দ্যাখো, জ্ঞানী সাজার ভান করতে একের পর এক বই প্রকাশ করছেÑ জীবনে ক’বার ভাত খেয়েছে কিংবা শৈশবে গাঁয়ের মাঠে হাঁটতে গিয়ে ক’বার হোঁচট খেয়েছে তা নিয়েও অকাতরে বই হচ্ছে। দশ বিশ এমনকি পঞ্চাশের বেশি বইয়ের মালিক অথচ ভেতরটা অন্তঃসারশূন্য হতে হতে একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতাকে আশীর্বাদ হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে না।
মু : তা তো সহজ নয় মহাশয়। বিত্ত দিয়ে চিত্তের দৈন্য দূর করা কঠিন কাজ। তবে একটা ভালো দিক আপনি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন। গত ক’বছরে এদেশে প্রকাশনা শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে। 
প্র : কিন্তু সেখানে তো শুনেছি নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অনেক প্রকাশনী নাকি এখন প্রবাসী বাঙালির বিত্তের কব্জায়। নিজ নামে বই প্রকাশ করে তারা দলে দলে জ্ঞানীর তালিকায় নাম লেখাচ্ছে আর মার খাচ্ছে সৃজনশীল প্রকাশকরা।
মু : হ্যাঁ আমিও শুনেছি এ রকম। তবে আবর্জনার স্তূপ ছাপিয়ে কিছু ভালো বই কিন্তু এখনো জ্বলজ্বল করছে- লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই।
প্র : হ্যাঁ তা করেছি। তবে এসব বইয়ের লেখকরা আমার মনে হয় মূলত সেই ভাষা আন্দোলনোত্তর প্রজন্ম। বয়সে প্রবীণ। নবীনরা কি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় তাদের পাশে দাঁড়াতে পেরেছে?
মু : একেবারে পারেনি তা-ই বা বলি কি করে। সৃজনশীল তরুণদের একটা ধারা তো পথ করে নিয়েছেই, যারা সত্যিকারার্থে সাহিত্যচর্চা করে। তাদের পাঠকও কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। কমল কুমার মুজমদারের কঠিন গদ্যেরও পাঠক ছিল; অদ্বৈত মল্লবর্মণের তো ছিলই। এদেশে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলীর পাঠক আছে। তবে তারা হুমায়ূন আহমেদের পাঠকের মতো দৃশ্যমান নয়। আচ্ছা মহাশয় বলুন তো, আপনি বই পড়া, আমি বই কেনার কথা বলেছি- আমরা আসলে কেমন পাঠক কুলের কল্পনা করেছিলাম?
প্র : আমার তো মনে হয় তুমি প্রথম যে লেখকদের নাম করেছ তাদের পাঠকদের মতো পাঠক কুলের কল্পনা করেছি যাদের লেখা পড়লে মানসচক্ষু খুলে যায়। মনের চোখ খোলার কথা তো আনাতোল ফ্রাঁসকে কোড করে তুমিই বলেছ। বলনি?
মু : জ্বি বলেছি। তবে সমসাময়িক, আপনার ভাষায় ‘এখনকার’ বই পড়া সম্পর্কে আপনি যেভাবে আনাতোল ফ্রাঁস ও বিলেতের কোনো এক ব্যারিস্টারের প্রসঙ্গ এনেছিলেন তা পড়ে আমি অভিভূত। কথাগুলো আমার এখনো হুবহু মনে আছে, শোনাব? আমার স্মরণশক্তির পরীক্ষা নেবেন?
প্র : তোমার পরীক্ষা নেব কি হে, আমার নিজেরই তো সব ঠিক ঠিক মনে নেই। তা ছাড়া তোমার স্মরণশক্তিকে সন্দেহ করার সাহসও আমার নেই। শোনাও।
মু : শুনুন তাহলে- ‘আনাতোল ফ্রাঁসর টাটকা বই পড়িনি, একথা বলতে প্যারিসের নাগরিকেরা যদৃশ লজ্জিত হবেন, সম্ভবত কিপিঙের কোনো সদ্যপ্রসূত বই পড়িনি বলতে লন্ডনের নাগরিকেরাও তাদৃশ লজ্জিত হবেন; যদিও আনাতোল ফ্রাঁসর লেখা যেমন সুপাঠ্য, কিপিঙের লেখা তেমনি অপাঠ্য। একথা আমি আন্দাজে বলছিনে। বিলেতে একটি ব্যারিস্টারের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। জনরব, তিনি মাসে দশ-বিশ হাজার টাকা রোজগার করতেন। অত না হোক, যা রটে তা কিছু বটেই তো। এই থেকেই আপনারা অনুমান করতে পারেন, তিনি ছিলেন কত বড় লোক। এত বড় লোক হয়েও তিনি একদিন আমার কাছে, অস্কার ওয়াইল্ডের বই পড়েননি, এই কথাটা স্বীকার করতে এতটা মুখ কাঁচুমাচু করতে লাগলেন, যতটা চোর-ডাকাতরাও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মঁরষঃু ঢ়ষবধফ করতে সচরাচর করে না। অথচ তার অপরাধটা কি? অস্কার ওয়াইল্ডের বই পড়েননি, এই তো? ...সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই, এ কথা কবুল করতে তিনি যে এতটা লজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন তার কারণ, তাঁর এ জ্ঞান ছিল যে, তিনি যত আইনজ্ঞই হোন, আর যত টাকাই অর্জন করুন, তাঁর দেশে ভদ্রসমাজে কেউ তাঁকে বিদগ্ধ বলে মান্য করবে না।’ ঠিক আছে মহাশয়?
প্র : আছে বলেই তো মনে হচ্ছে।
মু : তবে কি জানেন ওই ব্যারিস্টারের চেয়ে দু’তিন গুণ বেশি টাকা রোজগার করছে এমন লোক এদেশে এখন অনেক। তাদের সব আছে, সব কিছু। অভাব যা তা ওই লজ্জার। নিজের পড়া শোনার দৈন্যে লজ্জা পাওয়া দূরে থাক ফ্রাঁস বা ওয়াইল্ডের প্রতি ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে এরা নির্বিকার উচ্চারণ করতে পারে- এ্যাঁ, ও শালারা কি এমন করেছে, কটা বই-ই তো লিখেছে- ও আমিও পারি। ব্যস, বই লেখার ইচ্ছে পোষণ করেছেন মানেই ধরে নেওয়া যায় কম করে দুখানা বই হয়ে গেছে। বিষয়? ও নিয়ে চিন্তা নেই। যে কোনো কিছু বিষয় হতে পারে। আর কিছু না হলে কবিতা তো রয়েছেই। সুতরাং ফেলো কড়ি, ডাকো প্রকাশক-দু’মাসে বই শেষ। সব সময় কষ্ট করে নিজেকে লিখতেও হয় না। ভাড়াটে লেখক ডাকলে কাজটা তারাই করে দেন।
প্র : বল কি হে, ভাড়াটে লেখক!
মু : জ্বি মহাশয়। আরও আছে। বই তো হলো। এবার দরকার প্রকাশনা উৎসব, হল ভর্তি লোক ধন্য ধন্য করে প্রকাশনা উৎসব উদযাপন করবে। কোন কোন কাগজে রিভিউ বেরোবে। লেখকের সাক্ষাৎকার ছাপা হবে। সে এক দক্ষযজ্ঞ। মাস কয়েক পর সবাইকে অবাক করে পুস্তক প্রণেতা একখানা পুরস্কারও পেয়ে যাবেন। এ পুরো প্রক্রিয়ার কোথাও আপনি লজ্জার লেশমাত্র খুঁজে পাবেন না। যা পাবেন তা নগদ নারায়ণ।
প্র : এসব তুমি কী বলছ সৈয়দ?
মু : আজ্ঞে ঠিকই বলেছি। খোঁজ নিয়ে দেখলাম এবার মেলায় নতুন অনেক বই আসবে যার বেশির ভাগই কবিতা আর উপন্যাস। অন্যান্য বছরও তাই হয়। আপনি নিজেই তো দেখছেন প্রতিটি স্টলে উপচে পড়ছে উপন্যাস আর কবিতা।
প্র : প্রকাশকরা অচেনা লেখকদের এতসব বই প্রকাশের ঝুঁকি নেয়?
মু : প্রকাশরা তো বোকা নয় যে, ঝুঁকির মধ্যে যাবে। এসব বই লেখকরা গাঁটের পয়সা খরচ করে বের করে।
প্র : এ্যাঁ! সৈয়দ তোমার উল্টোপাল্টা কথা বন্ধ করো। আমার গা গোলাচ্ছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে, চলো এখান থেকে বোরোই।
মু : চলুন।
পায়ে পায়ে দু’জন এগিয়ে গিয়ে ‘বিশেষ যানে’ চড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
[সম্পূর্ণ কাল্পনিক]

×