ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ

ভাষার যত মান-অপমান

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ২০:০৪, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ২০:০৮, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ভাষার যত মান-অপমান

বাংলাদেশ আমাদের দেশ। আমাদের মাতৃভাষার নাম বাংলা ভাষা। আপনি আশ্চর্য হবেন জেনে, প্রবাসের বাঙালিরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন তাদের সন্তানদের বাংলা শেখানোর। এ কাজ সহজ কিছু নয়। কাজ আর কাজের ব্যস্ত সমাজে সপ্তাহান্তের ছুটি মিস করে যেসব অভিভাবক তাদের বাচ্চাদের বাংলা স্কুলে নিতে দৌড়ায়, তাদের শ্রদ্ধা জানাই। আমার মতে, এক জাতীয় ভাষাসৈনিক। ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার ঘটনা এখন ইতিহাস। আপনি চাইলেও আর বায়ান্ন ফেরত আনতে পারবেন না। পারবেন না নতুন করে ভাষা আন্দোলন গড়ে তুলতে। সম্ভব নয় সে চেতনাকে আগের শৈলী বা অবয়বে ধারণ করা। তা হলে কি আমাদের করণীয়?
যেসব অভিভাবক কাজ করলে আরও কিছু ডলার-পাউন্ড কামাতে পারতেন, জমাতে পারতেন, তারা তা না করে বাচ্চাদের বাংলা শেখানোর জন্য পরিশ্রম করেন। তারা নতুন ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র। কারণ, তারা মায়ের ভাষা বা দেশের মূল ভাষার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের যোগ ঘটাতে এমন শ্রম দেন। যখন সিডনি আসি তখন একটি কি দুটি প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কাজ করত। এখন তার সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি এলাকাভিত্তিক এসব স্কুল বা অন্য প্রক্রিয়াও চলমান। শুধু সিডনি না, পৃথিবীর সব দেশে বড় শহরে এ ধরনের কাজ চলছে। কেবল ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে নয়, সারাবছর ধরে চলা এই কার্যক্রমের সুফল পাচ্ছি আমরা। এখন যে কোনো অনুষ্ঠানে বা আয়োজনে একাধিক শিশু নির্ভুলভাবে বাংলায় কবিতা বলে, গান গায়। লেখা কঠিন হলেও বাচনে তারা দ্রুতই পারঙ্গম হয়ে উঠেছে। আরবি ও তামিল জনগোষ্ঠী ব্যতীত আর কারও ভেতর এমন তাগিদ দেখি না।
দুঃখের কথা হচ্ছে, আমরাই হয়তো একমাত্র জাতি, যারা নিজেদের মায়ের ভাষা শুদ্ধ করে বলতে বা লিখতে পারি না। যাদের অক্ষর জ্ঞান নেই, তাদের কথা আলাদা। যারা পড়ালেখা জানেন, নিজেদের শিক্ষিত বলেন, তারাই এমন করেন। স্কুল-কলেজের এমন শিক্ষকদের জানি, যারা সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার তফাৎ বোঝেন না। আমি হলে যে যাই আর অন্য কেউ হলে যে সে যায় হবে সেটাই জানেন না। এটা কোনো অজ্ঞতা নয়, এটা হচ্ছে না জানার অভিশাপ।


ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি আমাদের রক্তের ফসল। অথচ আমরা ভেবে দেখি না ভাষার জন্য কি করছি আমরা। দেশে ঘরে ঘরে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ানোর জোর প্রতিযোগিতা। মন্দ কিছু না। সবাই চাইবে তার সন্তান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মেশা বা মেধা বিনিময়ের সুযোগ লাভ করুক। চাইবে তারা বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। কিন্তু কারও ভিত্তি ঠিক না থাকলে সে যেমন দাঁড়াতে পারে না বা তার অবস্থান নড়বড়ে হতে বাধ্য, তেমনি নিজের ভাষা হচ্ছে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মূল ভিত্তি। এই ভিত্তিমূলের জন্য কি করছি আমরা? আপনাদের স্মরণ থাকতে পারে, একবার জাতীয় বইমেলায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন এক চেক ভদ্রলোক। চেক প্রজাতন্ত্রের নাগরিক এই মানুষটি বাংলা নিয়ে কাজ করেন বলে তাঁকে অতিথি করে আনা হয়েছিল। তিনি খুব মূল্যবান কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে, ছোট্ট দেশ চেক প্রজাতন্ত্রে তাদের ভাষায় যে কোনো বই পাওয়া সম্ভব। আণবিক বিজ্ঞান, মহাশূন্য কিংবা আইন বা চিকিৎসা শাস্ত্র সব বিষয়েই নিজের ভাষায় পুস্তক আছে তাদের। অথচ ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া বাংলাদেশে তা নেই। কেন নেই? উত্তর খুবই সহজ। আমাদের উদ্দেশ্য বা আদর্শ বহুমুখী। যে যেভাবে মনে করেন, সেভাবে ইতিহাস আর কবিতা-গল্পের বই নিয়ে ব্যস্ত। এতে দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু গবেষণা ও জীবনের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের কাজ কথার কথা হয়ে থেকে যাচ্ছে। ৭৫ বছর পর এই দুঃখ আসলেই আর দুঃখ থাকে না। হয়ে ওঠে হৃদয়বিদারক ভবিতব্য।
বলছিলাম প্রবাসের কথা। এখন বাংলাদেশীদের দাপট বিদেশের প্রায় সর্বত্র। যেখানেই বাংলাদেশী সেখানেই আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতির জয়জয়কার। এটি কোনো বিশেষ আবেগের জায়গা হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে যেটা দেখছি শহীদ মিনার বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজে যতটা আগ্রহ, ততটা আগ্রহ ভাষা বিস্তার বা ভাষা ব্যবহারে দেখি না। অথচ এটাই মূল শক্তি। এতদিনে এমনটা হতে পারার কথা যে, বিদেশের বড় বড় শহরে স্থানীয় বাংলাদেশী বা বাংলা ভাষার লেখকরাই তাদের বই-পুস্তক দিয়ে পুরোটা ভরিয়ে তুলবেন। সঙ্গে উপরি পাওনা থাকবে দেশ ও দেশের বাইরের বাংলা ভাষার লেখকের বই। আমরা এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষই মূলত বাংলা ভাষাভাষী। ফলে, এ দায়িত্ব আমাদের।
ভাষা আন্দোলনের আর একটি বড় শিক্ষা হচ্ছে সব ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আমাদের সম্মান আর ভালোবাসা জাগ্রত রাখা। দেশে যাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলি, তাদের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশে অবস্থান করেন। তারাও বাংলাদেশী। তাদের ভাষা আলাদা হতে পারে, কিন্তু তারাও আমাদের মূলধারার অনুগামী। সংখ্যায় যারা বেশি অর্থাৎ বাঙালিদেরই কর্তব্য তাদের সঙ্গে রাখা। এই কাজ অবিলম্বে হওয়ার প্রয়োজন আছে।
আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমি বলব, যে জাতি তার ভাষার জন্য জীবন দিতে পেরেছে, যে জাতি মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে দেশ অর্জন করেছে এবং রক্ত দিয়ে নিজেদের অধিকার ও গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে চায়, তাদের জন্য বাংলা ভাষার সম্মান অনেক বড় বিষয়। কিভাবে তা হবে বা হতে পারে, তা নিয়ে গবেষণার কারণ দেখি না। বাংলা ভাষা নিজেই একটি সুললিত ভাষা। জাতিসংঘ তাকে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করেনি। তার আছে নানাবিধ অর্জনের অহংকার। দেশের পাশাপাশি বিদেশের বাঙালির দেশাত্মবোধ আর ভাষার জন্য অনুরাগই আমাদের পথ দেখাতে পারে। এত বছর পরও বাংলা ভাষার অমর্যাদা নিয়ে কেন কথা বলতে হবে? বরং আমরা চাইব আমাদের দেশ ও জাতির ভিত্তি এই ভাষা অমর হোক। ছড়িয়ে পড়ুক সারা দুনিয়ায়। যার পতাকা বহন করবে আগামী প্রজন্মের সন্তানরা।
[email protected]

×