ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১

সৈয়দ মুজতবা আলী ॥ পাকিস্তানি এজেন্ট! ভারতের দালাল!!

নূরুর রহমান খান

প্রকাশিত: ১৯:৫৬, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১৯:৫৯, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সৈয়দ মুজতবা আলী ॥ পাকিস্তানি এজেন্ট! ভারতের দালাল!!

শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলমান ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯২১ সালে স্কুল বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ১৯২৬ সালে বিশ্বভারতী থেকে দু’জন বাচুভাই শুক্লা এবং সৈয়দ মুজতবা আলী স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। হাতে লেখা তাঁদের সনদপত্র অলংকরণ করেছিলেন নন্দলাল বসু এবং তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন বিশ্বভারতীর আচার্য গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অতঃপর ১৯৩২-এ জার্মানির বন্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে ডি. ফিল. ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য মুজতবা আলী সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে মনুষ্যত্বের সাধনার ব্রত নিয়েছিলেন। ধর্ম নয়- মনুষ্যত্বই মানুষের একমাত্র পরিচয়। এই সত্যবোধ অন্যদের মধ্যে জাগ্রত করতে হয়েছেন প্রয়াসী। বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দের সেতুবন্ধনের জন্য আমরণ নিরলস সংগ্রাম করেছেন। তার রচনায় সাম্রাজ্যবাদের প্রতি ঘৃণা, নির্জিত পরাধীন জাতির প্রতি অসীম করুণা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামী চেতনার প্রতি সশ্রদ্ধ অভিনন্দন, সর্বোপরি হিন্দু-মুসলমানের মিলন কামনায় তার আর্তি সুপ্রকাশিত। মুজতবার নিজস্ব শ্রেণিতে সাহিত্য গুরুদের উল্লেখে তার প্রমাণ বর্তমান- ‘আমি মুসলমান। আমার শাস্ত্রে আছে বিধর্মীর ভয়ে আল্লাহ রসুলকে বর্জন করা মহাপাপ। আমার সাহিত্যধর্মে গুরু-মুর্শীদ হয়ে আছেন রবিঠাকুর, হাইনে, তুর্গেনেভ, মাইকেল।’ তার আরেক মুর্শীদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কস্যচিৎ ভাইপোস্যের ভাষায় তিনি আপন রচনাশৈলীর দিকনির্দেশ লাভ করেছিলেন। তাই ‘বীরসিংহগ্রাম’ ‘তার তীর্থভূমি’।

দু’শ’ বছরের পরাধীনতার গ্লানি মুজতবা আলীকে ব্রিটিশের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তুলেছিল। ফলে সরকারি স্কুল বর্জন করেছেন, কখনো ইংরেজের অধীনে চাকরি গ্রহণের কথা ভাবতেই পারেননি এবং যে কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে তিনি মনুষ্যত্ব তথা মানবসভ্যতার নিকৃষ্টতম শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে কামনা করেছেন- ‘আমাদের যেন রাজ্য লোভ না হয়। ...পরাধীনতার বেদনা আমরা জানি। আমরা যেন কাউকে পরাধীন না করি।’ বিভাগোত্তরকালে ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বরে সিলেটে এক বক্তৃতায় আলী সাহেব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন- ‘পূর্ব পাকিস্তানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি তার ঘাড়ে উর্দু চাপানো হয় তবে স্বভাবতই উর্দু ভাষাভাষী বহু নিষ্কর্মাও শুধু ভাষার জোরে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার চেষ্টা করবে-... ফলে জনসাধারণ একদিন বিদ্রোহ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।’ মাত্র চব্বিশ বছরের মধ্যে তার বাণীর ষাথার্থ প্রমাণিত হয়েছে।
ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে জেহাদ ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনের মূলমন্ত্র এবং সর্বাবস্থায় মনুষ্যত্বের জয়গানে তার লেখনী ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। অথচ সাম্প্রদায়িক কাল্পনিক আচ্ছাদনে আবৃত করে তাকে লোকসমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা হয়েছে উভয় বঙ্গে। এই সম্প্রদায় পশ্চিম বাংলায় তার উদার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘ধুরন্ধর পাকিস্তানি এজেন্ট’-এর ‘একটা ‘বুব ধিংয’ বলে অপপ্রচারে মেতে উঠেছিল। তেমনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এদেরই সমগোত্রীয়দের বিচারে তিনি ছিলেন ‘ধুতি-চাদরপরা, তিলক-কাটা এবং নামাবলী গায়ে’ ‘পৌত্তলিকতার এজেন্ট, তেত্রিশ কোটি দেবতার মুসলমান পূজারী’ ‘বাংলা ভাষার হালজামানার খ্যাতিমান লেখক!’  পশ্চিম বাংলার ঈর্ষাকাতর হীনম্মন্যজন তার জীবন বিষময় করে তুলেছিল। তেমনি এ পারের স্বধর্মীয় গোঁড়া কূপমণ্ডূকদের ক্ষমাহীন আচরণ বীভৎস কুৎসিততম রূপ ধারণ করে তাঁর প্রাণ সংহারেও ছিল অকুণ্ঠিত। এরপরেও যেটা সুখের বিষয়, আনন্দের সংবাদ, সুস্থ মনের জন্য প্রত্যাশিত- তা হচ্ছে এই মর্কটদের দলই ‘শেষ সত্য’ নির্দেশ করেনি। সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের সাধক মুষ্টিমেয় হলেও আছেন এবং ছিলেন। তারা নির্ভীকচিত্তে অসত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অশ্লীলতার প্রতিবাদ করেছেন, মুজতবা আলীরা বৈরী পরিবেশেও আবিষ্কার করেছেন তারা একা নন, নিঃসঙ্গ মন, সুতরাং ভরসা হারাবার কোনো হেতু নেই। আলী সাহেব পরবর্তীকালে পরম শ্রদ্ধায় দুর্দিনের বন্ধু সমমর্মীদের প্রতি তার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। সর্বোপরি বাংলার বিদগ্ধ পাঠক সমাজ তাকে হৃদয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন একান্ত আপনজন হিসেবেই। যুগে যুগে লাঞ্ছিত হলেও তাদের দুঃখের কারণ নেই। বিশেষ করে মুজতবা আলী অবগত ছিলেন-
‘বাঙলাদেশে একটা দল আছে। ... এ দল পরপর রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র এবং সর্বশেষ রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধাচরণ করে উপস্থিত অন্তঃসলীলা। মোকা পেলে বুজ্বুজ্্ করে বেরুতে চায়।’ এই ‘বুজ্বুজের’ দল বিভিন্ন সময়ে মুজতবা আলীর মর্মান্তিক মানসিক নির্যাতনের কারণ হয়েছে। রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মাতৃভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং তারই ফলে ঢাকায় স্থাপিত হয় ‘বাংলা একাডেমি’। প্রতিষ্ঠানটির মুখপত্র ‘বাংলা একাডেমি পত্রিকা’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলে সৈয়দ মুজতবা আলী সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এ পঞ্চতন্ত্র কলামে পত্রিকাটির বলিষ্ঠ উদ্যোগের প্রশংসা করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সুতরাং তার আলোচনা পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং নিবন্ধকারদের মহত্তর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে তিনি আন্তরিক স্বাগত জানিয়েছিলেন। উক্ত পত্রিকায় এমন কয়েকটি প্রবন্ধ ছিল  যার মূল বক্তব্য- মাতৃভাষা চর্চায় বাঙালি মুসলমানের অবদান। কারণ সুস্পষ্ট। তখনো পূর্ব পাকিস্তানে সুপরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চলছিল বাংলাভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের কোনো যোগসূত্র নেই এবং ছিল না। এমনকি তাদের মাতৃভাষা বাংলা কি-না সে প্রশ্ন নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উপস্থাপন করা হতো। প্রকাশিত নিবন্ধগুলো ছিল তারই অভ্রান্ত জবাব। সম্ভবত পত্রিকা-পরিচিতিমূলক নিবন্ধটির মূল সুর উপলব্ধি করতে অসমর্থ জনৈক পাঠক মুজতবা আলীকে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করে ‘দেশ’-এর সম্পাদককে লেখেন, ‘এই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর বিবরণ হইতে মনে হইবে যে পূর্ব বঙ্গের সাহিত্য একমাত্র মুসলমানদিগেরই জিনিস। উক্ত পত্রিকার কর্মকর্তারা ভুলিয়া যাইতে চান যে হিন্দু-মুসলমানের সমবেত চেষ্টার ফলেই বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি ও পুষ্টি। হিন্দু কবিদের নাম ইচ্ছা করিয়াই এড়াইয়া যাওয়া হইয়াছে। ...অবশ্য কেহ যদি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িকতার সর্বনাশা সীমারেখা টানিতে চান সে কথা স্বতন্ত্র।’ পত্রিকাটির পীঠস্থান এবং সেখানকার সমকালীন রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হলে সম্ভবত তিনিও পত্রিকাটিকে সাদর সম্ভাষণ জানাতেন।
১৯৬৪ সালের ৩ অক্টোবর, আকাশবাণীর কোলকাতা কেন্দ্র থেকে মুজতবা আলীর একটি ‘সত্য ঘটনামূলক’ কথিকা ‘কোষ্ঠী-বিচার’ নামে প্রচারিত এবং শারদীয় বেতার জগতে গল্পাকারে প্রকাশিত হয়। বন্ধুপত্নী রাধারানী মুখোপাধ্যায় তার কনিষ্ঠা ভগ্নি সরজু গঙ্গোপাধ্যায়ের দুর্ভাগ্যের কাহিনী আলী সাহেবকে শুনিয়েছিলেন। সরজু দেবীর স্বামী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমা বর্ষণে বোম্বাই বন্দরে নিহত হন। ঘটনাটি অত্যন্ত নৈপুণ্য এবং সহৃদয়তার সঙ্গে মুজতবা আলী তুলে ধরেছেন ‘কোষ্ঠী-বিচার’এ। ভাগ্যাহত সরজুই হচ্ছে কোষ্ঠী-বিচারের মাধুরী এবং বোম্বাই বন্দর রূপান্তরিত হয়েছে মাদ্রাজে-এইটুকু মাত্র পরিবর্তন। কথিকাটি শ্রবণ ও পাঠ করে জনৈক বিক্ষুব্ধ শ্রোতা-পাঠক ২৪ অক্টোবর কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকায় লেখেন- ‘এরূপ একটি জাতিবিদ্বেষমূলক কথিকা (বেতার জগতে গল্প) প্রচার ও প্রকাশ মোটেই সমীচীন হয়নি, যখন ভারতবর্ষ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। যে কোনো হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক ....লেখকের এই হিন্দু বিদ্বেষমূলক আচরণে বিস্মিত ও বিক্ষুব্ধ হবেন। লেখক সাহিত্যের মধ্যে অশ্লীলতাকে যে কিভাবে স্থান দিলেন এবং আবার তা বেতার কর্তৃপক্ষ কী করে অনুমোদন করলেন, তা চিন্তার কথা। ... হিন্দু ও বাঙালির দেব-দেবীর পূজার উপর লেখকের বিদ্বেষ ও বিদ্রƒপ-কটাক্ষ মোটেই সহ্য করা যায় না। ....‘ওঁয়ারা তো ছিলেন, এঁয়ারাও এসে জুটলেন।’ এই রূপে হিন্দু দেবতা সম্বন্ধে তাচ্ছিল্যকর মন্তব্যের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য কী? ... এ রকম সাম্প্রদায়িক অসৎ মনোভাবের পরিচয় আরও মেনে।....এরূপ অশালীন ও ধর্ম বিদ্বেষমূলক ‘গল্প’ ‘বেতার জগৎ ও বেতার কর্তৃপক্ষ কী করে প্রকাশ ও প্রচার করলেন।’
‘মুজতবা আলীর এমন চমৎকার একটি কথিকার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ আবিষ্কার করার দৃষ্টান্তে’ ‘স্তম্ভিত’ বিশিষ্ট সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী তীব্রতম ভাষায় এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তার নয়টি শাণিত যুক্তির অন্যতম- ‘আচারসর্বস্বতা যদি হিনডুইজম হয় তাহলে তাতে প্রথম আঘাত হেনেছেন শ্রীচৈতন্যদেব। সতীদাহ যদি হিনডুইজম হয় তাহলে রামমোহন রায় তার অপমান করেছেন। চিরবৈধব্য রক্ষা যদি হিনডুইজম হয় তাহলে তার ওপর আঘাত হেনেছেন বিদ্যাসাগর। পুরোহিত প্রথা যদি হিনডুইজম হয় তবে বিবেকানন্দ ‘আগে পুরোতগুলোকে দূর কর’ বলে তাকে অপমান করেছেন।’ সবক’টি যুক্তি উপস্থাপন করে মোক্ষম বান ছুড়ে পরিমল গোস্বামী লক্ষ্য ভেদ করেছেন-‘আলোচ্যমান গল্পের লেখকের নাম আলী না হয়ে কোনো দেবশর্মা হলে কোনো প্রশ্নই উঠতো না।’ একটি পত্রে মুজতবা আলী একই  প্রসঙ্গে পরিমল গোস্বামীকে লিখেছিলেন, ‘ঢাকায় একটি কাগজে editorial রূপে সিরিয়াল  বেরুচ্ছে- আমি হেঁদু হয়ে গিয়েছি। ....ওরা বলে আমি কাফের, এরা বলে আমি নেড়ে। ভালোই রাইকুল শ্যামকুল দুই-ই গেল। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ’৭১-এর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম মুজতবা আলীকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ’৬৫ সালে বিশ্বভারতীর চাকরির মেয়াদ শেষ হলে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে বোলপুরের নিচাপট্টিতে চলে আসেন। শান্তিনিকেতনে মুজতবার বিরোধী পক্ষ একটা ছিল। এরাই রটিয়ে দিলো ‘পাকিস্তানি গুপ্তচর’ হিসেবে মুজতবা আলীকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। গুজবটি দিল্লিতেও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছিল। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমায়ূন কবীর সাহেবের কন্যা সাগরময় ঘোষকে টেলিফোন করে বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন। ১৩ এপ্রিল, ১৯৭৪-এ ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক শংকর ‘তুলনাহীন মুজতবা আলীতে’ লিখেছেন ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সময় অনেকে রটিয়েছে আলী সাহেব পাকিস্তানের সাপোর্টার।’ অতঃপর তার জিজ্ঞাসা, ‘এপার বাংলায় আমরাও বা কী দিতে পেরেছি তাকে।’ ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর পশ্চিম বঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় স্মৃতিচারণ করেছেন- ‘বাংলাদেশে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ঠিক তিনদিন আগে দিল্লিতে একটা টেলিফোন এলো। রাত তখন সাড়ে এগারোটা। টেনিফোন করছেন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি আবদুস সাত্তার। সাত্তার সাহেব বললেন, তিনি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানতে পেরেছেন যে, সেই রাত্রিতেই নাকি পশ্চিমবঙ্গের সব বিশিষ্ট মুসলমানদের গ্রেপ্তার করা হবে। আমি খবরটা শুনে বিস্মিত হলাম। ...আমি তখন পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। এরপর আমি প্রথম যে কাজটা করলাম তা হলো পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালকে ওই রাত্রিতেই টেলিফোন করে (পশ্চিমবঙ্গে তখন রাষ্ট্রপতির শাসন চলছে) রাজ্যপালকে বললাম, ‘আপনি সাময়িকভাবে গ্রেপ্তারের আদেশ মুলতবি রাখুন; প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমি আবার আপনাকে ফোন করছি।’ তখন মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত। ...গিয়ে শুনলাম ইন্দিরা ঘুমোচ্ছেন। আমি খুব জরুরি বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি শুনেই ইন্দিরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি ওঁকে সব কথা বললাম। শুনে প্রধানমন্ত্রী স্তম্ভিত। ...সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ল স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারের। তারা জানালেন, গ্রেপ্তারের আদেশের খবর সত্যি। ...শুনে ইন্দিরা রাগে ফেটে পড়লেন। অবিলম্বে এই আদেশ রদ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে অফিসারদের নির্দেশ দিলেন। সেদিন ইন্দিরা বিরক্ত হয়েছিলেন সেই সব সঙ্কীর্ণমনা আমলার ওপর যারা এই আদেশ দিয়েছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতিকে তোয়াক্কা না করেই।’
সুতরাং ১৯৬৫ সালের রটনা কিংবা মুজতবা আলীর নজরবন্দির ‘গুজব’ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে অগ্রাহ্য করা চলে না। এ প্রসঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষ্য- ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় শান্তিনিকেতনের কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক বিদেশী অর্থাৎ পাকিস্তানের দালাল বলে মুজতবা আলীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে চেষ্টা করে। প্রতিটি সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন লোক এজন্য লজ্জিত না হয়ে পারে না। বস্তুত মুজতবা কখনো শান্তিনিকেতন তথা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে যেতে চাননি। এমনকি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও তিনি কোলকাতায় বাস করারই পক্ষপাতী ছিলেন। যদিও শারীরিক কারণে তাকে যেতে হয়েছিল।’ ‘ধাপ্পাবাজদের’ বিরুদ্ধে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন সাগরময় ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ, অমিতাভ চৌধুরী, গৌরি আয়ুব প্রমুখ বিশিষ্টজন।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও এক শ্রেণি মুজতবা আলী সম্পর্কে নানাবিধ অপপ্রচারে আত্মসুখজনিত তৃপ্তি পেতো এবং তাদের অপকর্মটি চলেছে ধর্মের নামে। এদের সাফল্য-অসাফল্যের চেয়েও ভয়াবহ সত্যটি হলো- আলী সাহেব এ দেশে থাকলে আক্ষরিক অর্থেই এই পাষণ্ডদের হাতে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হতো, যেমনটি বাংলাদেশের বহু সুসন্তানের ভাগ্যে ঘটেছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে।
প্রাক্্ স্বাধীনতাকাল থেকে উত্তর-স্বাধীনতা সময়েও সৈয়দ মুজতবা আলী সংস্কৃত-আরবি-ফারসি ভাষা এবং টোল-চতুষ্পাঠী, মক্তব-মাদ্রাসাগুলো রক্ষার জন্য এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষকদের জীবনধারার মানোন্নয়ন করে দেশীয় ঐতিহ্য ও বৈষম্যের ধারাকে চলিঞ্জু রাখার উদ্দেশ্যে কী আপ্রাণ মসীযুদ্ধ চালিয়েছিলেন! আর এই ‘রামপন্টক যে গুহ্য তথ্যের সন্ধান পেলেন তা হলো, পরম বৈদান্তিক আহ্লাদে একেবারে বাগ্বাগ করে বগল বাজিয়ে সৈয়দ সাহেব সবাইকে সংবাদ দিচ্ছেন-‘রাষ্ট্রভাষা হিন্দি তার শব্দভাণ্ডার থেকে লাথি ঝাঁটা মেরে আরবি-ফারসি শব্দ বের করে দিচ্ছেন।.... তার যত আক্রোশ কেবল বেচারা আরবি-ফারসি শব্দাবলীর ওপর।... তিনি তার হিন্দিওয়ালাদের আরবি-ফারসি বিতাড়নে যে প্রক্রিয়ার এবং যে উপকরণের উল্লেখ করেছেন, তাতেই আরবি-ফারসি সম্বন্ধে তার মনোবৃত্তির পরিষ্কার ছায়াপাত ঘটেছে।
মুজতবা-জননীর সমাধি বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার শহরে। জীবদ্দশায় যে দেশে বাস করতে পারেননি, যে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি, জীবনান্তে সেই দেশেরই মৃত্তিকায় মাতৃসান্নিধ্যে অন্তিমশয্যা গ্রহণের বাসনা এবং ড. আলীর বহু কামনা-বাসনার মতো তার অন্তিম ইচ্ছাটিও অপূর্ণ। তবে আমাদের সান্ত্বনা এতটুকু যে, সৈয়দ মুজতবা আলী আজীবন মাতৃভাষার সেবা করেছেন, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় ছিলেন অগ্রণী সৈনিক, মৃত্যুর পরে তার শেষ শয্যা রচিত হয়েছে মহান ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদ আবুল বরকত ও শফিকুর রহমানের পাশে।

লেখক : প্রাক্তন অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

×