ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১

সংক্রামক রোগে সতর্কতা

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশিত: ২১:০৫, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সংক্রামক রোগে সতর্কতা

অত্যন্ত ঘন বসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। এদেশের প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজার তিনশ’ পঞ্চাশজন লোকের বসবাস। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে চারশ’ বিরানব্বই জন লোকের বাস। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে যদি তুলনা করি তাহলে দেখা যায়, তা যথাক্রমে  মাত্র আটত্রিশ জন, ৩.৫ জন এবং ৪ জন মানুষ প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করে। তাহলে বুঝতেই পারছেন মানুষের বসবাসের ঘনত্ব আর জীবনযাত্রার মান আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে কেমন বা কতটা উন্নত। জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছে। ৫ম স্থানে রয়েছে  মালটা, ৪র্থ স্থানে রয়েছে মালদ্বীপ। একইভাবে ৩য়,  ২য় এবং ১ম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে বাহরাইন, সিঙ্গাপুর এবং সানাকো। সংক্রামক রোগগুলো বেশি লক্ষ্য করা যায় অপরিচ্ছন্ন, দূষিত পরিবেশে বসবাসরত মানুষের মাঝে। যাদের আবাসিক অবস্থান অতটা উন্নত নয়। নোংরা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ জীবাণু ও জীবাণুর বাহকের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। পরিবেশ যত দূষিত হবে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ততই বৃদ্ধি পাবে। সব দিক বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ সংক্রামক রোগ-ব্যধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক। পরিবেশ দূষণ, জীবন যাপনের মান নিম্নমানের, পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারের অভাব, স্বাস্থ্য-সচেতনতার অজ্ঞতা, খাবার-দাবার তৈরি, পরিবেশন ও গ্রহণের যে মান রক্ষা করা প্রয়োজন তার স্বল্পতা বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে সংক্রামক রোগের এক অভয়ারণ্যের দিকে। অন্যদিকে পরিবর্তিত পরিবেশও অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করছে জীবাণু ও বাহকের অস্তিত্ব রক্ষায়।
সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে বাহক এবং বাহকের পরিবেশ,  জীবাণু এবং পোষকÑ এদের সধ্যে একটি সুন্দর ও ছন্দময় সুসম্পর্ক থাকে। যদি পরিবেশের উপাদানগুলো বাহকের অনুকূলে থাকে তবে বাহক যেমন অতি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবাণুকে বহন করতে পারে তেমনি জীবাণুও অতি সহজেই তার রেপ্লিকেশন ঘটিয়ে রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি করে মৃত্যু হার বাড়িয়ে দেয়। সেই জন্য পোষক-বাহক- জীবাণুু- পরিবেশ সম্পর্ক বোঝা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এই দেশে ঋতু-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, সূর্যের আলোর তীব্রতা, বাতাসের গতিবেগ প্রভৃতি পরিবেশগত উপাদানের তারতম্য ঘটে। এই তারতম্যের কারণে কখনো বাহকের বংশবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়, আবার কখনো জীবাণুর সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পায়। একইভাবে পরিবেশের দূষণ যেমন জীবাণুর-কর্মক্ষমতা বা সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, তেমনিভাবে, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস করে। এই সত্যতা সবাইকে সার্বিকভাবে উপলদ্ধি করেই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সচেতনতা এবং সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, আক্রান্ত হওয়ার হাত হতে নিজেকে রক্ষা করতে না পারলে দুর্ভোগ ভোগ করতে হবে নিজেকেই। তাই নির্দিষ্ট সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত এবং নিজ নিজ পরিবেশগত কাঠামোর ভিত্তিতে প্রণীত গাইডলাইন অনুযায়ী সকল প্রকার বিধিনিষেধ মেনেই চলতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলতে হয় ডেঙ্গু-ভাইরাস একজনের শরীর থেকে অন্য শরীরে পরিবাহিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাহকের ভূমিকাই প্রধান। তাই বাহকের হাত হতে সুরক্ষার জন্য অবশ্যই মশার প্রজনন প্রক্রিয়া অর্থাৎ জীবন চক্রের ধারা বা জীবন চক্রের ধাপগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। অর্থাৎ বাহক নামক এডিস মশকীর জীবন চক্র ও প্রজনন স্থল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। মশকীর আচরণ, মরফোলজি বা শরীরের বাহ্যিক গঠন, ডিম পাড়ার ধরন, স্থান এবং সানুষের সংস্পর্শে আসার সময় ও সংবেদনশীলতা প্রভৃতি বিষয়গুলো জানতে পারলেই ডেঙ্গুব বাহককে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। ডেঙ্গুব বাহক নিয়ন্ত্রণে এলেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব হতে পারে। আমরা জানি, এখন ডেঙ্গু শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার যে ২টি প্রজাতিÑ এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস এলবোপিকটাস এখন সমানতালে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। ২০২৪ সালের প্রি- মুনসন এবং মুনসন এডিস মশা জরিপে শহরে এডিস ইজিপ্টি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে এডিস এলবোপিকটাসÑ এর ঘনত্ব লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে কৃত্রিম প্রজনন স্থল যেমনÑ নারিকেল মালাই, নির্মাণাধীন বিল্ডিংÑ এর নিচে ফ্লাডিং ফ্লোর, জমানো পানি, কনটেইনার, টায়ার,  অথবা বহুতল ভবনের পানির পাম্প প্রভৃতিতে এডিস ইজিপ্টির উপস্থিতি অত্যন্ত বেশি ও উদ্বেগজনক। প্রাকৃতিক উৎস যেমনÑ কচুগাছ, কলাগাছের পাতার এক্সাইল, গাছের ছিদ্র বা কুঠুরি, ব্যাম্ব ট্রাম্প প্রভৃতির মধ্যে এডিস এলবোপিকটাস এর ঘনত্ব বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইভাবে উভয় প্রজাতিই ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে চলেছে। সেইজন্যই আর শহর ও গ্রামাঞ্চলে আক্রান্ত মশার ঘনত্ব নির্র্ণয় করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তা হলো গ্রামাঞ্চলে পড়ে থাকা এডিস এলবোপিকটাস কিভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত সহজ। এখন যোগাযোগ মাধ্যম অত্যন্ত সহজ হওয়ার ফলে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির চলাচলে অত্যন্ত সহজেই গ্রামাঞ্চলে চলে যাচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাস। এই আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত যখন এডিস এলবোপিকটাস পান করে তখন খুব সহজেই মশাটি আক্রান্ত হয় এবং সমান্তরাল ও ভার্টিক্যালÑ দুদিকেই ডেঙ্গু বিস্তার লাভ করে।
ভার্টিক্যাল বিস্তার অর্থাৎ, এক জেনারেশন হতে অন্য জেনারেশনে বিস্তার লাভ খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলে। এটা আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে যথার্থ কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের অভাবে। পুরোপুরিভাবে যদি আক্রান্ত রোগের রোগীর সত্যিকারের ঠিকানা অনুসন্ধান করা না যায়, তাহলে বিনা বাধায় আক্রান্ত মশা ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়াবে। এক্ষেত্রে যেমন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, একইভাবে বাড়ছে আক্রান্ত মশার সংখ্যা। বৃদ্ধি পাচ্ছে আক্রান্ত এলাকা। ক্রমেই সংক্রামিত মশা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নির্বিঘ্নে বাড়িয়ে চলছে। এমতাবস্থায় প্রয়োজন রোগীর প্রকৃত ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে সচেতনতা ও সমন্বিত উদ্যোগ। নিজ নিজ দায়িত্বে নিজের এলাকায় সকল অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক। সমন্বিতভাবে আই পি এম এবং আই ভি এম এর সমন্বয়ে আইপিভি-এ অর্থাৎ, সমন্বিত বালাই ও বাহক ব্যবস্থাপনা জরুরি।
বাঁদুড় দ্বারা একইভাবে শীতকালে নিপাহ ভাইরাসের যে প্রাণঘাতী আবির্ভাব, মূল্যবান জীবন কেড়ে নিচ্ছে তা  থেকে পরিত্রাণের উপায় হলোÑ সচেতনতা। কাঁচা খেজুর রস বাঁদুড়ের বিষ্টা হতে রক্ষা করা এবং কাঁচারস পান করা থেকে বিরত থাকা উচিত। বাঁদুড়ের দ্বারা অর্ধ-খাওয়া ফল কখনই খাওয়া যাবে না। রস উৎসবসহ এমন সামাজিক উৎসবগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। আমাদের মতো দেশের মানুষদের মধ্যে সংক্রামক রোগের বিস্তার খুব সহজেই হতে পারে উন্নত দেশগুলোতে তত সহজে সম্ভব নয়। তাই সচেতনতার বিকল্প নেই। রোগের জীবান বা প্যাথোজেনের যেমন আধিক্য তেমনি বাহকের আধিক্য ও তৎপরতা ব্যাপক। পানিবাহিত, বায়ুবাহিত, খাবারবাহিত সংক্রামক রোগগুলোর বিস্তার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছে। বর্তমানে সারাদেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের যে পরিমাণ ডার্স্ট পার্টিক্যাল রয়েছে তা শুধু সংক্রামক রোগই ছড়াচ্ছে না, অগ্রণী ভূমিকা রাখছে এনসিডি বা নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ ছড়াতেও। সিওপিডি, ল্যাং ক্যান্সার, স্ট্রোক, হার্ট-ডিজিজসহ অসখ্য মারাত্মক রোগ ছড়াচ্ছে। এতে মানুষের আউট পকেট এক্সপেনডিচার-অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের মানুষের অতি দারিদ্র্যতার মূল কারণ ২টি । একটি হলো মামলা সংক্রান্ত ব্যয় এবং অন্যটি হলো চিকিৎসা ব্যয়। পরিবর্তিত পরিবেশে আমরা যদি সচেতন ও সতর্কতার সঙ্গে রোগ-জীবাণ প্রতিরোধ করতে না পারি, তাহলে সংক্রামক রোগের সংক্রমণ ইমার্জিং এবং রি-ইমার্জিং হতেই থাকবে। মূলবান জীবন অকাতরে ঝড়তে থাকবে। তাই আসুন ভয় বা গুজবে কান না দিয়ে নিজেকে সচেতন করি এবং অন্যকে সতর্ক হতে উদ্বুদ্ধ করি। একটি সুস্থ সাবলীল  সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তুলি।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব-বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান,
নিপসম, মহাখালী

×