ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১

রাখাইনের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত কৌশল

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ২০:৩৯, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রাখাইনের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত কৌশল

নিকটতম প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তকে ঘিরে রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক গতিশীলতা এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাখাইন রাজ্য ক্রমশ আরাকান আর্মির প্রভাবাধীন হয়ে পড়েছে। সেখানে একটি নতুন রাষ্ট্র, রাখাইন গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ একটি কৌশলগত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সীমান্ত নীতি, প্রতিবেশী সম্পর্ক এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের সমাধান কৌশল পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে- যেখানে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্বার্থের জটিল মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।

ঐতিহাসিকভাবে আরাকান নামে পরিচিত রাখাইন রাজ্য দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত ও রাজনৈতিক অস্থিরতার  কেন্দ্রবিন্দু। শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি অঞ্চলটির ওপর উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। যার ফলে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাখাইন একটি স্বায়ত্তশাসিত বা এমনকি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা এখন বাস্তবতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ পরিবর্তন আঞ্চলিক ভূরাজনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য।  
রাখাইনের কৌশলগত অবস্থান এটিকে প্রধান শক্তিগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (BRI) অংশ হিসেবে রাখাইনের কিয়াউকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক করিডর রয়েছে, যা ভারত মহাসাগরে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। ভারতও এই অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিশেষ আগ্রহী। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো রাখাইনে চীনের প্রভাব প্রতিহত করতে সচেষ্ট। যা ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
নতুন একটি রাখাইন রাষ্ট্রের আবির্ভাব বাংলাদেশের জন্য একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা বয়ে আনতে পারে। একদিকে, এটি একটি সম্ভাব্য নতুন প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ করে দিতে পারে। অন্যদিকে, সীমান্ত নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু নিয়ে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে।  
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি হলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন, যারা নিপীড়ন ও সহিংসতার কারণে রাখাইন থেকে পালিয়ে এসেছে। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে এক মিলিয়নের বেশি  রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার ফলে বাংলাদেশ ব্যাপক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত চাপে পড়েছে। একটি নতুন রাখাইন রাষ্ট্র গঠিত হলে, নতুন আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট সমাধানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। তবে এটি অর্জনের জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্য, আস্থার পরিবেশ গড়ে তোলা এবং রাখাইন কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মির সঙ্গে কৌশলগত সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা অপরিহার্য হবে।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার অনিয়ন্ত্রিত ও প্রায়ই অস্থির সীমান্ত বারবার উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমান্তবর্তী মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান এবং বিদ্রোহী  গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা সীমান্ত ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। একটি নতুন রাখাইন রাষ্ট্র গঠিত হলে এই সমস্যাগুলো আরও বেড়ে যেতে পারে অথবা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ধরন অনুযায়ী নিরাপত্তা সহযোগিতার নতুন সুযোগ তৈরি হতে পারে।  
বাংলাদেশকে রাখাইনে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর স্বার্থের জটিল সমীকরণ দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে হবে। চীনের গভীর সম্পৃক্ততা একদিকে সম্ভাবনা তৈরি করলেও, অন্যদিকে ঝুঁকিও বহন করছে। চীনের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে  রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা সম্ভব হতে পারে। তবে এর কৌশলগত অগ্রাধিকার বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের সঙ্গে মিলবে কিনা, তা বিশেষভাবে বিবেচনার বিষয়। একইভাবে, ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি ও রাখাইনে সংযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি, যাতে বাংলাদেশের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় থাকে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর কার্যকর সমাধানে বাংলাদেশকে একটি সক্রিয় ও বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এই  কৌশলের প্রধান উপাদানগুলো হওয়া উচিত-  
কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা- বাংলাদেশকে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাখাইনের উদীয়মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। অঞ্চলটির অন্যতম প্রধান অংশীজন আরাকান আর্মির সঙ্গে পরোক্ষ কূটনৈতিক আলোচনা (ব্যাকচ্যানেল ডিপ্লোমেসি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সংলাপের মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থা গড়ে তোলা, সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের সদ্ব্যবহার- বাংলাদেশকে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে হবে, বিশেষ করে চীন ও ভারতের সঙ্গে। পাশাপাশি, পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনও নিশ্চিত করা জরুরি। রাখাইনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের জন্য মধ্যস্থতাকারী ও শান্তির পক্ষে সমর্থক হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অর্জন করতে পারে। এছাড়া, আসিয়ান (ASEAN) এবং জাতিসংঘের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।  
সীমান্ত ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন- সীমান্তবর্তী অপরাধ প্রতিরোধ ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে উন্নত সীমান্ত নিরাপত্তা অপরিহার্য। বাংলাদেশকে আধুনিক নজরদারি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে, সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে শক্তিশালী করতে হবে এবং প্রতিবেশী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে। যৌথ সীমান্ত টহল ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের মতো সমন্বিত পদক্ষেপ সীমান্ত উত্তেজনা কমাতে ও পারস্পরিক আস্থা গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে।  
অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি- রাখাইনের সঙ্গে স্থিতিশীল ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে পারে। বাণিজ্য, পর্যটন এবং অবকাঠামো উন্নয়নে যৌথ বিনিয়োগ উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক হতে পারে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সীমান্ত বাণিজ্য করিডর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাখাইনকে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব হবে, যা বিদ্রোহ ও সংঘাতের প্রলুব্ধতা কমাতে পারে।  
দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি- আন্তর্জাতিক আলোচনায় অতীতের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায়, বাংলাদেশকে কূটনীতি ও  কৌশলগত বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের প্রস্তুত করতে হবে। প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নীতি-সংক্রান্ত থিঙ্ক ট্যাঙ্কে বিনিয়োগ করলে জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দক্ষতা বাড়বে। প্রবাসী বাংলাদেশী সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা এবং তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোও ফলপ্রসূ হতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা- রাখাইনে স্থিতিশীলতা ও উনয়ন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো  দেশগুলোর উচিত সংঘাতের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং রাখাইনে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করা। জাতিসংঘসহ অন্যান্য বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর উচিত সংলাপকে উৎসাহিত করা, মানবিক সহায়তা প্রদান করা এবং অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর নজরদারি জোরদার করা।  
ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি- বাংলাদেশের রাখাইন নীতি অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত,  যেখানে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নকে অগ্রাধিকার  দেওয়া হবে। রাখাইনের সঙ্গে টেকসই সম্পর্ক উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক হতে পারে, যা আঞ্চলিক সংহতি ও পারস্পরিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। তবে, বাংলাদেশকে সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট থাকতে হবে। বাংলাদেশকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে যে, সমস্যা শুধু রাখাইনের সঙ্গে নয় সম্পর্কিত নয়- এখানে মিয়ানমার, চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশগুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।  
রাখাইন রাজ্যের রাখাইনের পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতা বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত কৌশল ও আঞ্চলিক নীতিগুলো পুনর্গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। একটি সক্রিয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জগুলোকে সুযোগে পরিণত করতে পারে, যা অঞ্চলটির জন্য আরও স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে।

লেখক: অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×