ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৬ মাঘ ১৪৩১

আগ্রাসী অসুস্থ মন!

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২১:২২, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আগ্রাসী অসুস্থ মন!

ধর্ষণের খবর প্রতিদিন আমাদের আহত, ক্ষত-বিক্ষত করে চলেছে। অতীতে ব্যাপক প্রতিবাদ ও সমালোচনার কারণে একটি মামলার বিচারে ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, তারপরও থেমে থাকেনি ধর্ষণ। মনে হচ্ছে ধর্ষণের জন্য শিশুদের টার্গেট করছে কিছু অমানুষ। কারণ, প্রায়ই খবরের কাগজে দেখি শিশুরা ধর্ষিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। যা খুবই দুঃখজনক। যেমন সম্প্রতি রাজধানীতে হাত-পা বেঁধে ৫ জন মিলে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরীকে। পরে মরদেহ ফেলে দেওয়া হয় হাতিরঝিলে। এ ঘটনায় জড়িত দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অভিযুক্ত আরও তিনজনকে খুব দ্রুত ধরতে হবে। তারপর তাদের চরম শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।
শিশুরা হলো নিষ্পাপ এবং ফুলের পাপড়ির মতো। কিন্তু মানুষরূপী নরপশুদের হাত থেকে শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। কি খারাপ সময় সমাজ অতিবাহিত করছে দেশ ও জাতি? যা নিয়ে সরকার, অভিভাবক এবং আমরা সবাই দুশ্চিন্তায় রয়েছি। এখান থেকে আমাদের খুব শীঘ্রই মুক্তি পাওয়া দরকার। অন্যথায় আমাদের আগামী দিনের স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। এই শিশুরাই ভবিষ্যতে দেশ নেতৃত্ব দেবে। তাদের আমাদের রক্ষা করতে হবে। রক্ষা করা রাষ্ট্র, সরকার এবং আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৪ হাজার ৭৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬২৭টি। তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা নেমে এসেছে ৩২৯-এ। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত চার বছরে বাংলাদেশে প্রতি ৯ ঘণ্টায় একটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ শুধু গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় গত চার বছরে বাংলাদেশে প্রতিদিন অন্তত দুজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
অতীতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ২ বছর ১০ মাস বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ গণমাধ্যম মারফত জানতে পারি। কি হচ্ছে এসব? কী বর্বরতা? নানা সময়ে দেখা যায় প্রতিবেশীরা তরুণ শিশুদের নানাভাবে ফুসলিয়ে ধর্ষণ করে থাকে। আবার দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনা স্থানীয় প্রভাবশালীদের বাধায় অনেক পরিবারকে আইনি ব্যবস্থা নিতে সমস্যায় পড়তে হয়। অর্থাৎ সমাজের কিছু মানুষ আবার এসব অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। অনেক জায়গায় দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনাটিও বিচার-সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করার পাঁয়তারা করা হয়। যারা এর সালিশি করে, তাদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। যারা ধর্ষণ করে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।  
অতীতে শেরপুরে গৃহকর্মী শিশুকে ধর্ষণের মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শিশুটির পরিবার ও পুলিশের তথ্য অনুসারে, অপরাধীদের একজনের বাড়িতে চার-পাঁচ মাস আগে শিশুটি গৃহকর্মীর কাজ নেয়। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় শিশুটিকে ভয়ভীতি দেখিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করেন ওই বাড়ির কর্তা-ব্যক্তি। গভীর রাতে সিঁদ কেটে শিশুকে তুলে নিয়ে নদীর পাড়ে নিয়ে ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপকর্মের ঘটনা শুনতে পাই, এটা কি কোন মানুষের কাজ হতে পারে? এদের ধিক্কার জানাই। অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানানভাবে শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো অপরাধ অনেক বেড়েছে। যেভাবে হোক, এসব বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে দরকার সামাজিক প্রতিরোধ এবং সামাজিক ঐক্য। সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি পরিবারের দায়িত্ব রয়েছে যে তার ছেলেমেয়ে কোথায় যায়, কার সঙ্গে ঘোরাফেরা করে। সর্বদা শিশুর প্রতি পিতা-মাতার নজর এবং খোঁজখবর নিতে হবে।
যুগ যুগ ধরে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে দেশে শিশু ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে আইন আছে, কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগ খুবই কম। ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগী মামলা করলে কিছুদিনের মধ্যেই অপরাধীরা জামিনে মুক্ত হয়ে যান। পরে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকেন ভুক্তভোগীরা। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। দেশজুড়ে ধর্ষণ প্রতিরোধে প্রতিবাদ–বিক্ষোভ চলছে কিন্তু শিশু ধর্ষণের ঘটনা থামছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও নিকটাত্মীয়রা অভিযুক্ত। শিশু ধর্ষণ বা নির্যাতনসহ অন্যান্য অপরাধ কমাতে দ্রুত বিচার করতে হবে। এ ছাড়া রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সকল দলের মধ্যে এ রকম ইস্যুতে সম্মিলিতভাবে কাজ করা জরুরি। ধর্ষণ বা যে কোনো অপরাধ নিয়ে রাজনীতি করা সঠিক না বলে মনে করি। এ ছাড়া ধর্ষণ বন্ধে শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। শিশুকাল থেকে ছেলেমেয়েদের জন্য পৃথক স্কুল না থাকাই ভালো। যাতে একে অপরকে বন্ধু এবং নিকটতম সঙ্গী ভাবতে পারে।   
সমাজে শিশু নির্যাতন বা ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধ প্রবণতা এমন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শিশুদের মনে এক আতঙ্ক এবং ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। শিশুরা যেখানে যায়, সেখানে তারা ভীতিতে বসবাস করে। যা কোনোভাবে হওয়া উচিত নয়। এভাবে শিশুরা আতঙ্ক নিয়ে বেড়ে উঠলে তাদের ভেতরে সুস্থ বুদ্ধি, মননশীল চিন্তা-চেতনা বা সৃজনশীল মেধার বিকাশ হওয়া কঠিন। তাই মনে করি, ধর্ষণ বা শিশু নির্যাতনে লণ্ডভণ্ড আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ।
যৌন নিপীড়নের শিকার শিশুদের সহায়তার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স তৈরি করতে হবে। পুলিশকে যৌন সহিংসতার ঘটনাগুলো রিপোর্ট করতে এবং আদালতের মাধ্যমে মামলা প্রক্রিয়াকরণের গতি এবং সংবেদনশীলতা উন্নত করার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে সামাজিক ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ইউনিট, প্রত্যেক এলাকায় শিশু নির্যাতন বন্ধে কমিটি, পুলিশ ও আদালতের কর্মকর্তাদের লিঙ্গ প্রশিক্ষণ, ধর্ষণ অপরাধের জন্য মহিলা থানা এবং আদালত প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
ফুল যেমন পাপড়ি মেলে সৌরভ ছড়ানোর অপেক্ষায় থাকে, তেমনি শিশুরাও একদিন ফুলের মতো সৌরভ ছড়াবে এই অপেক্ষায় থাকি, কিন্তু কি নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন এবং ধর্ষণ আমরা দেখতে পাই কিছু মানুষ নামে নরপশুদের কারণে। যে শিশুদের চোখের তারায় থাকে অপার সম্ভাবনা। বিকশিত হওয়ার পূর্বে অনেক নিষ্পাপ শিশুকে আমরা অকালে হারিয়ে ফেলি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিশুদের ধর্ষণ ও নির্যাতন আমাদের একটি প্রবল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধার, এক একটি শিশু এক একটি স্বপ্ন ও ফুল। সর্বোপরি বর্তমান সরকারকে আরও বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে ধর্ষকদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

×