ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৬ মাঘ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন ও সমকালীন বাস্তবতা

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২১:১৯, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ভাষা আন্দোলন ও সমকালীন বাস্তবতা

সপ্তম শতাব্দীতে যখন বাংলা ভাষার উন্মেষ হয় তখন থেকেই জাতিরাষ্ট্রের ধারণা উপ্ত হয়। বাংলাদেশে জাতি গঠন প্রক্রিয়া প্রায় দেড়-দুই হাজার বছরের বিষয়। এ দেশের বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্যকে প্রথম একত্র করেন রাজা শশাঙ্ক সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে। ৭৫০ থেকে শুরু করে ১০৯০ সাল পর্যন্ত বৌদ্ধ পাল রাজার অধীনে এ প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়। এরপর সেন রাজবংশ ১০৯৫ থেকে শুরু করে ১২৩০ সাল পর্যন্ত দেশটিকে মোটামুটিভাবে একীভূত রাখে। অতঃপর আফগান এবং তুর্কি মুসলমানরা (১২০১-১৫৫৬ খ্রি.) এ দেশে তাদের রাজত্ব বহাল রাখে। ১৩৪২ সালে সর্বপ্রথম শামসুদ্দীন ইলিয়াছ শাহ নিজেকে ‘শাহে বাঙালিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করলেন। যাকে বলা হয় সুলতানি আমল। তাদের রাজত্ব নানা বাধা-বিপত্তির মুখে সপ্তদশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত বহাল থাকে। বাংলাদেশের সেই সময়ের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময় ছিল হুসেন শাহী রাজত্ব, যার শুরু হয় ১৪৯৩ সালে। বস্তুতপক্ষে তখনই এ দেশে মধ্যযুগের অবসান হয়। মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে সুবা-বাংলা যদিও ১৫৫৭ সালে প্রতিষ্ঠা পায়, কিন্তু সারাদেশটি তাদের অধীনে নিয়ে আসতে তাদের আরও প্রায় ৫০ বছর চলে যায়। দিল্লির মোগল সম্রাটদের অধীনে বাংলাদেশের সুবাদার বাস্তবে এদেশের স্বাধীন নবাব হিসেবে অবস্থান রাখেন। ব্রিটিশ শাসনামলে (১৭৫৭-১৯৪৭ খ্রি.) বাঙালির স্বতন্ত্র সত্তা বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
ব্রিটিশ ভারতে যুগপৎ খেলাফত-অসহযোগ আন্দোলন (১৯১৯-১৯২২ খ্রি.) ব্যর্থ হওয়ার পর বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের চিন্তা-ভাবনা অনেক এগিয়ে যায়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিনচন্দ্র পাল, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কিরণ শঙ্কর রায়, বিধানচন্দ্র রায় সবাই বাংলাদেশে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন। দেশবন্ধুর ১৯২৩ সালের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের সূচনা করে। আবার ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পূর্বক্ষণে সোহরাওয়ার্দী-শরৎবসুর যুক্তবাংলা চুক্তি বাংলাদেশের পূর্বসূরি হিসেবে আবির্ভূত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন (১৯৪৮-১৯৫২ খ্রি.), ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৬৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরোধিতা, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৮-৬৯ সালের আগরতলা মামলা মোকাবিলাÑ এসব আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে ১৯৭১ সালে। আর এসব আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগ উত্থাপিত সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। নবগঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহল প্রথম বিতর্ক শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভাষাগত ভিন্নতা এবং ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুদৃঢ় করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম বহির্প্রকাশ। এ আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এলিটদের মধ্যে এক প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বের সূচনা করে। বাংলা ভাষার ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও মুসলিম লীগ চক্রের আক্রমণ ছিল মূলত বাঙালি জাতির আবহমান ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, হাজার বছরের ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের ওপর আঘাত। ভাষা আন্দোলনই ছিল এদেশের প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং এই আন্দোলনের মধ্যে অবচেতন বাঙালির জাতীয়তাবাদী অনুভব ছিল। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করলে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জ্ঞানগর্ভ যুক্তি দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পাল্টা প্রস্তাব করেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি বাস্তব কথা।’ ড. মুহম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘ইহাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সর্বনাশ ঘটিবে।...উর্দু বহিয়া আনিবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মরণÑ রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু।’ এর ফলে পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সমাজের মধ্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও বাংলা ভাষার দাবিকে জোরদার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানিদের অধিকাংশের মাতৃভাষা বাংলার ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের আগ্রাসনের কারণ হিসেবে তারা যদিও ‘এক পাকিস্তানের সংহতি’র দোহাই দিয়েছিলেন, কিন্তু এর নেপথ্যে কাজ করেছিল ঔপনিবেশিক চিন্তা-ভাবনা। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে যাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ না ঘটে সে বিষয়ে তারা প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলেন। তাদের মনে আশঙ্কা ছিল যে, বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পুরো পাকিস্তানের ওপর বাঙালি জাতির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে। তাই তারা প্রথম থেকেই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা শুরু করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সরকারি ফরম, ডাকটিকিট, মুদ্রা, রেলের টিকিট প্রভৃতিতে কেবল ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহার করা হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিষয় তালিকা থেকে এবং নৌ ও অন্যান্য বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষায় বাংলাকে বাদ দেওয়া হয়। এমনকি পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুকে নির্ধারণ করা হলে পূর্ব বাংলার শিক্ষিত মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়।
সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের শাসকমহল সমাজ ও রাজনীতির মৌলিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর নগ্নভাবে আক্রমণ শুরু করে। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে সম্মেলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামে একটি প্রগতিশীল যুব সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। এ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে মাতৃভাষাকে সংস্কৃতিচর্চা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়ার দাবি জানানো হয়। ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ছাত্র-শিক্ষকদের যৌথ উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিশ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে এ সংগঠনটি বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও আইন-আদালতের ভাষা করার পক্ষে প্রচারণা চালায়। তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উর্দু? শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেসদলীয় সংসদ সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা রাখার প্রস্তাব করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানসহ সরকারদলীয়রা এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ভাষা আন্দোলনের ব্যাপকতা এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত সভায় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। নবগঠিত এ পরিষদের আহ্বানে ১১ মার্চ সারা বাংলায় প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। এ প্রতিবাদ দিবসে পূর্ব পাকিস্তান সচিবালয়ের প্রথম গেটের সামনে বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন পরিষদের আহ্বায়ক শামসুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ নেতা। এ গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৩ মার্চ ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় এবং ১৫ মার্চ পর্যন্ত এ ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ খাজা নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৮ দফা সংবলিত একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করার বিষয়টি প্রাদেশিক পরিষদে উত্থাপিত এবং গৃহীত হলেও ক্ষমতাসীন দল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করার বিষয়টি এড়িয়ে যায়। ২১ মার্চ রেসকোর্সের গণসংবর্ধনায় প্রদত্ত বক্তৃতায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে জোর দেন এবং যারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে নিয়োজিত তাদের দেশের শত্রু বলে আখ্যায়িত করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র-জনতা আন্দোলন করার কারণে নাজিমুদ্দিন সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর যেভাবে জুলুম, নির্যাতন চালিয়েছে জিন্নাহ্ তার নিন্দা না করে বরং মুসলিম লীগ সরকারের কর্মকাণ্ডে সমর্থন জানান। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পুনরায় জিন্নাহ্ একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ছাত্ররা আবারও তীব্র প্রতিবাদ করে। ১৯৪৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী পূর্ব বাংলার ফজলুর রহমান পেশোয়ার শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সভায় আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করেন। এ ঘোষণা প্রচারের পরই ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা তীব্র প্রতিবাদ জানান।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৫২ সাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বলেন, ‘কায়েদে আজম উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ নাজিমুদ্দিনের এ বক্তব্যের প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। এভাবে আন্দোলন ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ওঠার পটভূমিতে পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী বিক্ষোভ মিছিলসহ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবি হরফে বাংলা চলবে না’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট পালন করে। পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দিন থাকায় পরবর্তী ধর্মঘটের জন্য ২১ ফেব্রুয়ারিকে বেছে নেওয়া হয়। এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল উক্ত বাজেট অধিবেশনে পরিষদের সদস্যদের সমর্থন আদায় করে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রস্তাব পাস করানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। কিন্তু মুসলিম লীগ প্রশাসন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে সকল প্রকার সভা-সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে প্রাদেশিক পরিষদের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দিতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ এবং লাঠিচার্জ শুরু করে। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালালে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, রফিক উদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম, শফিকুর রহমানসহ নাম না জানা কয়েকজন শহীদ হন। ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলির প্রতিবাদে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রমুখ সদস্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশন কক্ষ থেকে ওয়াকআউট করেন।
পরিশেষে ১৯৫৬ সালে রচিত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা অপরিসীম। এটা শুধু ভাষাগত কিংবা সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল সামন্তবাদের তাঁবেদার পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক-শোষক শ্রেণির জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণের এক ব্যাপক গণআন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে রচিত পূর্ব বাংলার প্রথম প্রতিবাদী নাটক ‘কবর’-এর রচয়িতা মুনীর চৌধুরী, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদ, ভাষা আন্দোলনের ওপর রচিত উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’-এর রচয়িতা জহির রায়হান, গণপরিষদের অধিবেশনে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা রাখার দাবি উত্থাপনকারী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখকেও মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিকট জীবন দিতে হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির এ আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। পৃথিবীর কোথাও ভাষার নামে কোনো দেশ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছে ভাষার নামে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিই একমাত্র জাতি যারা একই সঙ্গে ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করেই ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১-এর চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটাতে সাহায্য করেছিল। এটি ছিল বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে এ ভাষা আন্দোলন পরবর্তী আন্দোলনসমূহ সফলভাবে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। এভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার যে স্ফুরণ ঘটায় তা আর থেমে থাকেনি; বরং পর্যায়ক্রমে আরও বিকশিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও যুদ্ধের বদৌলতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ভাষা আন্দোলন তৎকালীন রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এই আন্দোলনের ফলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ ঘটে।
তবে বর্তমান সময়ে আমরা ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে হারিয়ে যেতে বসেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিই একমাত্র জাতি যারা একই সঙ্গে ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। অথচ এখনো উচ্চ আদালত, চিকিৎসা, প্রকৌশলবিদ্যাসহ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলিত। অথচ এ ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য ভাষা শহীদরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, অনেকেই পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন, অনেকেই কারাজীবন ভোগ করেছেন। আমাদের উচিত ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সমুন্নত রাখা।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×