ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৬ মাঘ ১৪৩১

একুশের চেতনায় জেগে উঠুক ভাষার গৌরব

হৃদয় পান্ডে

প্রকাশিত: ১৯:২৫, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

একুশের চেতনায় জেগে উঠুক ভাষার গৌরব

বাংলা ভাষা বাঙালির আত্মপরিচয় একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই ভাষার জন্য বাঙালি জাতি যে সংগ্রাম আত্মত্যাগের নিদর্শন রেখেছে তা বিশ্ব ইতিহাসেও বিরল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি বাঙালির ভাষা সংস্কৃতির জন্য আত্মোৎসর্গের প্রতীক। সেই চেতনা আজও আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়, শিকড়ের টানে ফিরিয়ে আনে নিজের ভাষা সংস্কৃতির গৌরবে। একুশের চেতনা শুধু ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলন নয়, এটি স্বাধীনতার বীজবপন, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই এবং একটি জাতির আত্মমর্যাদার প্রতিচ্ছবি। যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তখন বাঙালির হৃদয়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল। তাদের চোখে মুখে জ্বলছিল ভাষার জন্য বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা। ২১ ফেব্রæয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামে এবং পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত জব্বার। তাদের এই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় এক অনন্য ইতিহাস, যা পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি রচনা করে।

একুশের চেতনা আমাদের যুগিয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস। ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য নয়, এটি ছিল রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি বৃহত্তর আন্দোলন। ভাষা হচ্ছে জাতির আত্মার পরিচয়। যে জাতি তার ভাষা সংস্কৃতিকে সম্মান করতে জানে না, সেই জাতি কখনো উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে না। তাই একুশের চেতনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে ভাষা আমাদের পরিচয়, আমাদের স্বপ্ন এবং আমাদের সংগ্রামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একুশের প্রভাব শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রæয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা বিশ্বব্যাপী ভাষার বৈচিত্র্য এবং মাতৃভাষার গুরুত্বের স্বীকৃতি। এটি বাঙালির জন্য একটি বিরল গৌরবের মুহূর্ত। এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি শুধু একটি তাৎক্ষণিক বিজয় নয়, এটি একটি দায়িত্বও বহন করে। এই দায়িত্ব হলো, আমাদের ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে সেই গৌরবময় ইতিহাসকে সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া।

বর্তমানে বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা যোগাযোগের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, যা স্বাভাবিক এবং বাস্তবসম্মত। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে বাংলার চর্চা এবং এর মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে অনুভ হচ্ছে। অনেকেই আজকাল বাংলার পরিবর্তে অন্য ভাষায় কথা বলা বা লেখাকে আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করছেন। কিন্তু এই প্রবণতা আমাদের শিকড় থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। একুশের চেতনা আমাদের এই ভুল দিক থেকে সরিয়ে আনতে পারে, যদি আমরা তা হৃদয়ে ধারণ করি। শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলার ব্যবহার মর্যাদা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে। উচ্চশিক্ষা প্রযুক্তি শিক্ষায় ইংরেজি প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি বিশ্বমানের শিক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর পাশাপাশি মাতৃভাষার চর্চা গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অবহেলা করা উচিত নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন ভারসাম্য রাখা দরকার, যেখানে বাংলা এবং ইংরেজি উভয়ের সঠিক ব্যবহার মর্যাদা নিশ্চিত হয়। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে মানসম্পন্ন গবেষণা এবং প্রকাশনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

একুশের চেতনায় ভাষার যে গৌরব আমরা অর্জন করেছি, তা যেন শুধু প্রতীকী না থাকে। বরং প্রতিদিনের জীবনে তা যেন কার্যকর হয়। আমাদের সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক, সংগীত এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ বাংলার সৃজনশীল ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে সামনে রেখে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ভাষার প্রতি ভালোবাসা গর্বের বোধ জাগানো অত্যন্ত জরুরি। আজকের প্রজন্মের জন্য একুশের চেতনা কেবল ইতিহাস নয়, এটি একটি প্রেরণা। তারা যেন ভাষার গৌরবকে আরও উজ্জ্বল করে, নতুন নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে পারে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলে আমাদের নিজেদের ভাষা সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে হবে, তার প্রতি অবিচল থেকে সেই গৌরবময় ইতিহাসকে বুকে ধারণ করতে হবে।

অবশেষে, একুশের চেতনা আমাদের শিক্ষা দেয় যে ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে যে আত্মত্যাগ আমাদের পূর্বসূরিরা করেছেন, তা যেন আমাদের পথ দেখায়। আমরা যেন সেই চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে নিজেদের ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে আগামীর জন্য আরও সমৃদ্ধ করি। একুশের এই মহান চেতনায় জেগে উঠুক আমাদের ভাষার গৌরব, আমাদের দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ুক সেই গৌরবের আলোকচ্ছটা।

 

শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

×