![পল্লী উন্নয়ন ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা’র ভূমিকা পল্লী উন্নয়ন ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা’র ভূমিকা](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/befunky_2025-1-6_15-37-27-2502080942.jpg)
ছবিঃ সংগৃহীত
যেকোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহত্তর উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পূর্ব পাকিস্তানে অবকাঠামো উন্নয়নের ক্রটি ও বিচ্যুতি সুষম ও জনকল্যাণমূলক উন্নয়ন অন্তরায় ছিল। বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তান সরকার অসম উন্নয়ন অবকাঠামো পল্লীর মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। অবহেলিত পল্লীর উন্নয়নে কথা বলেছেন ও তৎকালীন সরকারের সাথে দেন-দরবার করেছেন যাতে দেশের সামগ্রীক উন্নয়নের স্বার্থে পল্লী উন্নয়ন বাদ না পড়ে।
সেসময় পল্লীর মানুষের জন্য ছিলনা স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল না এছাড়া সড়ক বলতে বোঝাতো শুধু মেঠোপথ আর কাঁচা মাটির রাস্তাকে। কালের বিবর্তনে সে চেহারা হয়তো অনেক খানি বদলেছে। আজ হয়তো আমরা পিচঢালা সড়কে চলাচল করছি এবং এখন আর উন্নয়ন বলতে শহরের একচেটিয়া অধিকার নেই। পল্লীঞ্চলের অনেক সড়কই এখন পাকা হয়েছে। এইসব সড়ক ব্যবহার করে আজ গ্রামীণ কৃষকের উৎপন্ন শস্য ও কৃষিপণ্য দ্রæততম সময়ের মধ্যে শহরাঞ্চলের বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে। ধারাবাহিক এই উন্নয়নের পেছনের ও পরিবর্তন এসেছে অনেক মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে ফল স্বরূপ। সেই সময়ে আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠাতা খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা পিছিয়ে পড়া পল্লীর মানুষের নিয়মিত ভাবে কাজ করেছেন। তিনি গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য সড়ক ও সেতুর নির্মাণে মনোনিবেশ করেন, যা পল্লীর মানুষের চলাচল ও বাণিজ্য সহজতর করেছে, এলাকার মানুষের নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান উদ্যোগী ছিলেন, পল্লীর স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে কাজ করেন, যা পল্লীর মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়।
খানবাহাদুর আহ্ছাউল্লা কর্তৃক আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠাতার পেছনে যে কটি কারণ নিহিত আছে তার মধ্যে অন্যতম পল্লী উন্নয়ন অন্যতম। আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের কথা বলতে যেয়ে তিনি বলেন ‘‘মিশনের মেম্বরগণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পল্লী-উন্নয়নের জন্য, রাস্তা-ঘাট নির্মাণের জন্য, দুঃস্থকে সাহায্যের জন্য”।
তিনি আরো বলেন ‘‘অপরের খেদমত করাই ইহার উদ্দেশ্য; অন্য উদ্দেশ্য হইতেছে-ভ্রাতৃত্ব স্থাপন, দু:খীর অভাব নিরাকরণ, শিশু ও বয়স্কদিগের দীনিয়াত শিক্ষাদান, পরদা সংরক্ষণ, পল্লী-উন্নয়ন ইত্যাদি”। (আমার শিক্ষা ও দিক্ষা বই হতে উধ্বৃত)।
আর এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এক্ষেত্রে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) নিজ উৎসাহে ও উদ্যোগে সাতক্ষীরা জেলার রাস্তা ঘাট নির্মাণ, স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন, স্কুল-মাদ্রাসা, হোস্টেল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নিরলস ভাবে করে গেছেন। তিনি বলেন ‘‘শ্রমিক বেশে রাস্তা তৈরারী করিব, আর সেই রাস্তার আশেকের পদ-ধূলি বক্ষে লাইয়া চরিতার্থ হইব” (আমার শিক্ষা ও দিক্ষা বই হতে উধ্বৃত)।
তিনি নানামুখী ও সমাজকল্যাণমুখী কর্মকান্ডে নলতা গ্রাম ও সাতক্ষীরার উন্নয়নে তৎকালিন পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দরখস্ত দিয়ে এলাকার অভাব-অভিযোগ তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে আহ্ছানিয়া মিশনের সেক্রেটারী জনাব এম. জওহার আলীকে এক পত্র লেখেন “তুমি শুনিয়া খুশী হবে কালীগঞ্জে একটী ও সাতক্ষীরাতে আর একটা দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হইতেছে। নলতার বুকে একটী প্রতিষ্ঠিত হইলে মৃত্যুর সময় শান্তিসহ ইহকাল ত্যাগ করতে পারবে”। তার এই পত্র থেকে বোঝা যায় কতটুকু কমিটমেন্ট থাকলে তিনি বলেছেন ‘‘মৃত্যুর সময় শান্তিসহ ইহকাল ত্যাগ করতে পারবে”।
স্থানীয় শিল্পের উন্নয়ন হ্যন্ডলুম বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন, যা স্থানীয় বস্ত্র শিল্পের বিকাশে ভ‚মিকা রাখে, ফলে কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎস বৃদ্ধি পায়।
তিনি বেশ কয়েকটি সামাজিক সংগঠন ও যুবক সংগঠন তৈরী করেন। পল্লীর উন্নয়নে সামাজিক সংগঠনগুলোর সাথে কাজ করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেন। এভাবে, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা’র উদ্যোগ ও নেতৃত্ব পল্লীর অবকাঠামো ও সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তিনি শ্নেহের কয়েসউদ্দিন এক পত্রে লেখেন ‘‘ পু: নলতা হাই স্কুল বর্তমান উবাবষড়ঢ়সবহঃ ঝপযবসব এর অন্তর্গত হয়েছে। এ বৎসর ২০ হাজার টাকা সরকার দিয়াছেন, আগামী দুই বৎসরে ঐরূপ দিতে থাকবেন আর সংলগ্ন মডেল প্রাইমারী স্কুলটী ৬০০০ টাকা সরকার হতে পেয়েছে- সবই নঁরষফরহম বাবদ। মহাপ্রভুর করুণাধারা নেমেছে”
তিনি শিক্ষার প্রসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। তিনি বলেন ‘‘নলতা গ্রামে আহ্ছানিয়া মিশনের তত্ত¡াবধানে সাতক্ষীরা মহকুমায় একটা লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত থাকিবে, সেখানে মিশনের মেম্বরগণ সাময়িকভাবে অবস্থান করিতে পারিবেন। উহার সংলগ্ন থাকিবে একটী ধর্মীয় পুস্তকাগার ও গরীবদের সেবার জন্য থাকিবে দাতব্য চিকিৎসার ব্যবস্থা। এতদুপলক্ষেযে ব্যয় হইবে শাখা মিশন তাহা বহন করিবেন”। এছাড়া মিশনের পক্ষ হইতে নলতা মছজিদের দক্ষিণে আর একটী লাইব্রেরী (ধর্মীয় পাঠাগার) প্রতিষ্ঠিত থাকিবে এবং সাতক্ষীরা লাইব্রেরীর অনুকরণে পরিচালিত হইবে”।
‘‘সাতক্ষীরা মহকুমা ও নলতা গ্রামে দুইটী মিশন লাইব্রেরী (ধর্মীয় পুস্তকাগার) থাকিবে এবং উহাদের সংলগ্ন জায়েরীণদিগের সাময়িক অবস্থানের বন্দোবস্ত ও গরীবদের জন্য দাতব্য চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকিবে। উভয় লাইব্রেরীর পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা থাকিবে’’।
তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সামাজিক কর্মকান্ডে এগিয়ে আসার জন্য আহŸান করেন এবং একত্রীত করার চেষ্টা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন ‘‘সমাজের প্রত্যেককে এই স্বরাষ্ট্র- সৌধের নির্মাণ কল্পে সাহায্য করিতে হইবে-শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক পরিশ্রম দ্বারা”। তিনি তৎকালিন নবগঠিত পূর্বপাকিস্থানের পিছিয়ে পড়া ও অনগ্রসার জনগষ্ঠির উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের টেকসই উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন। তিনি বলেন ‘‘প্রত্যেকের শক্তির ব্যবহার করিতে হইবে; প্রত্যেককে কর্ম্মবীর, জ্ঞানবীর ও ধর্ম্মবীর হইতে হইবে। দুর্ব্বলকে সবল, অচলকে সচল, ভীরুকে নির্ভয়, নিঃসহায়কে সহায় করিতে হইবে। ভিক্ষাবৃত্তি উঠাইয়া দিয়া কর্ম্ম-বৃত্তির উন্মেষ করিতে হইবে”। তার চিন্তার গভীরতা সর্বকালের সমাজ সেবক ও সমাজ চিন্তকদেরও হার মানায়। আজও আমরা কতটুকু তার এই কথার মমার্থ অনুধাবন করতে পেরেছি তা বিশ্লেষণযোগ্য বলে আমরা মনেকরি।
কালিগঞ্জ ও দেবহাটা থানার মধ্যে একটী হাসপাতালের অভাব তিনি অনুভব করেছিলেন যার কারনে এই দুই থানার মধ্যে হাসপাতাল নির্মানের তাগীদ অনুভব করেন এবং সে অনুসারে উদ্যোগী হন। তিনি মিশনের সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করেন ‘‘নলতার দাতব্য-চিকিৎসালয়ের সহিত একটী হাসপাতালের অনুষ্ঠান করিতে হইবে এবং ব্যাধিগ্রস্ত অচল ব্যক্তিদের জন্য অন্ততঃ চারিটী ফ্রি বেড্ উক্ত হাসপাতালে সংযোজিত করিতে হইবে”।
তিনি ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে জঁৎধষ ফরংঢ়বহংধৎু ঝপযবসব এর দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব করেন (ফাইল নং আইডি-২০/৪৯)। ১৯৬২ সালে তৎকালিন যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুর সবুর খান এর কাছে এক পত্রে তিনি সাতক্ষীরা থেকে কালিগঞ্জ পর্যন্ত কুঞ্চা সড়কটি প্রাকৃতির আধার সুন্দরবন পর্যন্ত সম্প্রসারণের প্রস্তাব করেছিলেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, খুলনার মাধ্যমে পাকিস্থানি পোস্ট এবং টেলিগ্রাফ বিভাগে ১৯৫৯ সালে (নং গ-১১-১১৪) যশোর ও সাতক্ষীরার মধ্যে একটি মেইল মোটর সার্ভিস চালুর প্রস্তাব করেন।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা প্রেরিত ২০শে জুলাই, ১৯৬২ তারিখের পত্রের প্রতিউত্তরে মহকুমা কর্মকর্তার কার্যালয়, সাতক্ষীরা থেকে মহাকুমা কর্মকর্তা এ. কে. এম. সিদ্দিকুল্লাহ তাঁকে এক পত্রে (মেমো নং ৫৭৭/প., ফঃ/- ২৫. ৭. ১৯৬২) জানানো হয় যে, সাতক্ষীরা ভেটখালী সড়ক মেটাল করার প্রকল্প গ্রহণের বিষয়টি যোগাযোগ মন্ত্রী, সরকারের নজরে আনা হয়েছে। পাকিস্থানের, অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্যে তিনি অন্তভ‚ক্ত করে এই বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পরেই উল্লিখিত রাস্তাটির প্রাথমিক কাজ শুরুকরা হবে। এভাবে তিনি নিরন্তর পল্লী ও পল্লীর মানুষের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করেগেছেন। পল্লী উন্নয়ন ও সামাজিক কর্মকান্ডে তাঁর অবদানের এমন শতশত উদাহরন তুলে আনতে পারি এবং এই উদাহরন সমূহ আমাদের পথ দেখাতে পারে ও উৎসাহিত করতে পারে।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা’র জন্মের শতবর্ষ পরে এসে আমাদের আতœবিশ্লেষনের প্রশ্ন সামনে এসে দাড়িয়েছে, আমরা তাঁর বহুমাত্রীক গুনাবলী ও বৈশিষ্টকে কত টুকু ধারণ করতে পেরেছি। এই মাহামানব যে আত্মিক শান্তি, প্রেম, এবং মানবতার সেবার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, তা আমাদের জীবনে কতটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে?
আত্মিক উন্নয়েনর পথে সহায়ক হিসেবে কি সামাজিক দায়িত্ব পালন করছি? এগুলো ভাবনার মাধ্যমে আমরা নিজেদের কর্মকান্ড এবং দায়িত্ব সমূহ মূল্যায়ন করতে পারি। সামাজিক দায়িত্ব পালন করা আমাদের মানবতা ও সম্প্রীতির জন্য অপরিহার্য, যা খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা’র দর্শনে আন্তনিহীত আছে।
সূত্র:
১. আমার জবীন ধারা
২. আহ্ছানিয়া মিশনের মত ও পথ
৩. বার্ষিক সাধারণ সভার কার্যবিবরনী
মারিয়া