![শেখ হাসিনার পতন: আওয়ামী লীগের নিঃশেষ হওয়ার পরিণতি শেখ হাসিনার পতন: আওয়ামী লীগের নিঃশেষ হওয়ার পরিণতি](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/hasian-20240806155213-2502080924.jpg)
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত।
দীর্ঘ ১৬ বছরের সীমাহীন দুঃশাসন শেষে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ঘটে, পতনের সাথে মিশে যায় অভূতপূর্ব ইতিহাস। এক সময় সাহসী ভাষণে নিজের শক্ত অবস্থান তুলে ধরলেও, বাস্তবতার চাপে পড়ে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়। কত দম্ভ ছিল তাঁর, কত অহমিকা, সব মাটিতে মিশে গেল। মানুষের দিকে কথাগুলো এখন নিজের দিকে ফিরে ফিরে আসছে তাঁর। অনেক ঘটনারও পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। মানুষকে বাড়িছাড়া করতে গিয়ে হয়ত আজ চিরদিনের জন্যই দেশছাড়া হয়ে গেলেন। এটাকে ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য বলার চেয়ে আমি কর্মফল বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার পথে ছাত্র আন্দোলন, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ নানাবিধ কারণে জনগণের ক্ষোভ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। ভারতের ওপর নির্ভরতা ও সীমান্তে বিএসএফের অত্যাচার উপেক্ষা করা তাঁর জনপ্রিয়তার আরও ক্ষতি করে। সর্বশেষ, জুলাই-আগস্টের গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং শেখ হাসিনা পলায়ন করতে বাধ্য হন। রাজা লক্ষ্মণ সেনের পরে দ্বিতীয় রাজা হিসেবে পলায়ন করলেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার পতন শুধু তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে, আশঙ্কা দেখা দেয় আওয়ামী লীগ নামক দলটিরই হারিয়ে যাওয়ার। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্রজনতার প্রতিবাদ প্রতিবাদ এক বৃহৎ গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। সাধারণ মানুষ, তরুণরা, এবং নির্যাতিত রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত, জনগণের চাপে পড়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাঁকে, এবং তাঁর দল আজ কঠিন বিচারের মুখোমুখি।
ক্ষমতা হারানোর ছয় মাস পরও আওয়ামী লীগ আত্মসমালোচনা বা অনুশোচনার পথে যায়নি। গণহত্যার দায় স্বীকার না করে দলটি এখনো এটিকে ষড়যন্ত্র হিসেবে চিত্রিত করছে। শেখ হাসিনার বিভিন্ন ফাঁস হওয়া ফোনালাপে প্রতিশোধের মনোভাব প্রকাশ পায়, যা রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তোলে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের বিচার শুরু হয়েছে। কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে, দিনে দিনে দাবি জোরালোর পথে আগাচ্ছে। ব্যাপার হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিকভাবে একটা স্বৈরাচারী দল। শেখ মুজিব যুদ্ধের পরে দায়িত্ব নিয়েই দেশকে একটা আবদ্ধ কারাগারে পরিণত করে। সকল দল মতকে রাজনীতি করার সুযোগ বন্ধ করে দেয়, এমনকি আওয়ামী লীগ নামেও রাজনীতি থাকে না আর, হয়ে যায় একদলীয় শাসনব্যবস্থা-বাকশাল। শেখ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাও হাঁটেন বাবার দেখানো পথেই, কোথাও কোথাও যেন ছাড়িয়ে যান বাবাকেও, বিশেষ করে সীমাহীন লুটপাট, অর্থ পাচারের দিক দিয়ে।
দিন দুয়েক আগে নিজের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ছয় মাস পর শেখ হাসিনা একটি অনলাইন বক্তব্য দেন, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। এতে তাঁর প্রতিশোধমূলক মনোভাব ফুটে ওঠে, এবং ছাত্র-জনতা এর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্ররা "বুলডোজার মিছিল" এবং "মার্চ টু ধানমন্ডি ৩২" কর্মসূচির ডাক দেয়। এর ফলে সারা দেশে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ ঘটে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, যা জনগণের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের প্রতিফলন। বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া, তবে স্পষ্টত বিজয় আওয়ামী লীগের হয়েছে। শেখ হাসিনা যেন চাচ্ছিলেন এমন কিছুই হোক। এটাকে পুঁজি করে বিশ্ববাজারে বেচাকেনা শুরু করতে পারবেন, বিশেষ করে সরকারকে মৌলবাদ বানানোর প্রচেষ্টা তো শেখ হাসিনার প্রভু রাষ্ট্র ভারতের মিডিয়ার ছিলই। সেই আগুনে ঘি ঢালল কালেমা সম্বলিত পতাকা এবং নারায়ে তাকবির ধ্বনি। ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিস্ট হাসিনা হাজার হাজার ছাত্র জনতাকে হত্যা করেও তাঁর ক্ষমতার লালসা যায়নি এখনো, বিন্দুমাত্র অনুশোচনা তো নেই, উলটো দোষারোপ করে যাচ্ছেন ক্ষমতা হারানোর জন্য। আগে ছিল স্বজন হারানোর বেদনার ন্যাকা কান্না, এর সাথে যোগ হয়েছে গদি হারানোর বেদনার নাটকীয় কান্না, ছিঁচকাঁদুনে তো তিনি বরাবরই ছিলেন।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সংগঠিত হতে ব্যর্থ হয়, নিজেদের এত জৌলুস, এত ক্ষমতা! কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫ দেশে প্রতিবাদ করার লোকের বদলে যেভাবে মিষ্টি বিতরণের লোকের অভাব ছিল না, তেমনইভাবে ৫ই আগস্ট, ২০২৪ শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে আসার লোক ছিল না, ছিল কোটি মানুষের বিজয়ের প্রতিধ্বনি। মূলত এই দলটার আগাগোড়া সবাই ক্ষমতার পূজারি, অর্থের পূজারি। এদের চিন্তা চেতনা শুধু আত্মকেন্দ্রিক, নিজের আখের গোছানোর জন্যই এরা রাজনীতি করে, মানুষের কথা ভাবে না। দেশের মানুষকে অবশ্য শত্রু মনে করে এরা। খুব স্বাভাবিকভাবেই তৃণমূল নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যায়, দলীয় কার্যালয় ছিন্নমূল মানুষের আস্তানায় পরিণত হয়। যাদের মধ্যে বুদ্ধির বালাই কিছুটা হলেও আছে তাঁরা রাস্তাঘাটে নামার চিন্তাভাবনা করে না। কারণ নিজেরাই হুমকি ধামকি দিয়ে আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় কয়েকজন দোসর ওবায়দুল কাদের, সাদ্দাম, ইনান। ক্ষমতার এত বাহাদুরি, কিন্তু নেই সাহসের লেশমাত্র! শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, গুম, নির্যাতনের মামলা চলমান থাকায় তাঁর প্রত্যর্পণের জন্য বাংলাদেশ ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে। এক সময়কার ক্ষমতাসীন দল এখন রাজনৈতিক সংকটে আছে, এবং তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিনপিকে নিয়ে তো তাঁদের অনেক কথা, অনেক সমালোচনা, অনেক টিপ্পনী। এর আগে বিএনপি কঠোর দমন-পীড়নের মধ্যেও সংগঠিত ছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগের বর্তমান পরিস্থিতি তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বকে প্রকাশ করছে। ৬০ লাখের ওপর নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা রাজনৈতিক মামলা, সহস্রাধিক মানুষকে বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম খুনের পরেও বিএনপি বিগত ১৬ বছর সকল সংকটে সংগ্রামে রাজপথে থেকেছে। কিন্তু নিজেদেরকে বীর বাহাদুর মনে করা দলটা ছয় মাসেই বিলীন, এটা শুধু মানুষের সাথে সংযোগের অভাবের ফলাফল। আওয়ামী লীগ কখনো গণমানুষের দল হতে পারেনি, সবসময় হেঁটেছে মানুষের উলটো পথে।
শেখ হাসিনার পতন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এটি দেখিয়ে দিয়েছে যে, যেকোনো স্বৈরাচারী শাসক জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারে না। দেশ স্বাধীন হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছে সার্বভৌমত্বের জন্য, মানুষের অধিকারের জন্য কিন্তু ক্ষমতার লোভে দলটি স্বৈরতন্ত্রের পথে হেঁটেছে। গণহত্যার অপরাধ, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, এবং অনুশোচনাহীন আচরণ আওয়ামী লীগের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করেছে। এবং অচিরেই নির্মূল হয়ে যাওয়ার পথেই আগাচ্ছে এই সন্ত্রাসী সংগঠন।
নুসরাত