ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৫ মাঘ ১৪৩১

ঔষধ শিল্পের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

রফিউল কলিম রিফাত

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঔষধ শিল্পের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম উপকরণ। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ঔষধ শিল্প কেন্দ্রীয় অবস্থানে  রয়েছে। দেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে হাতেগোনা কয়েকটি ওষুধ উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু আশির দশকের পর থেকে ঔষধ শিল্প সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিকশিত হতে শুরু করে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ওষুধের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অথচ ৫০ বছর আগে ওষুধ প্রাপ্তির জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে। বর্তমানে দেশের  চাহিদা মিটিয়ে  ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৫৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে ওষুধ রপ্তানিতে বিশেষ শর্ত শিথিলের সুবিধাভোগী দেশগুলোর মধ্যে ওষুধ রপ্তানি করছে একমাত্র বাংলাদেশই। বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২৬৯টিরও বেশি ছোট-বড় ওষুধ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৪টি কারখানা নিয়মিতভাবে ওষুধ উৎপাদন করে যাচ্ছে। এসব কারখানায় প্রায় ৫ হাজার ব্র্যান্ডের ৮ হাজারেরও বেশি ওষুধ উৎপাদন করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় সব ধরনের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। আর এসব উৎপাদিত ঔষধ পণ্য বিশ্বের প্রায় ১৬০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ভবিষ্যতে ঔষধ শিল্পে বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
এত সাফল্যের পরও সম্ভাবনাময় এ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন যে সুবিধা পাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে সেই সুবিধা আর থাকবে না। তখন বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের অবস্থা কী হবে, কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। উত্তরণকালীন বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে বাংলাদেশের। বাজারসুবিধা, কম সুদে ঋণসহ নানান বিষয়ে আলোচনা শুরু হলেও ঔষধ শিল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি মহলে তেমন কোনো আলোচনা হয় না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে এলডিসি হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কপিরাইট আইন বা ‘মেধাস্বত্ব ছাড়ের’ সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশ, যার মেয়াদ ২০৩৩ সাল পর্যন্ত দেওয়া আছে।
এই সুবিধার আওতায় ওষুধ উৎপাদনে বিদেশী পেটেন্ট ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে কোনো রয়্যালিটি বা কোনো ধরনের ফি দিতে হয় না। যে কারণে অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সস্তায় ওষুধ উৎপাদন করতে পারছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘বাণিজ্য-সংক্রান্ত মেধাস্বত্ব’ (ট্রিপস) আইনে বাংলাদেশকে পেটেন্ট করার অধিকার দেওয়া রয়েছে। কেননা, ওষুধ উৎপাদনে বিদেশী পেটেন্ট ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে রয়্যালটি বা ফি দিতে হবে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে ওষুধের। যার প্রভাব পড়তে পারে ওষুধের দামের ওপর। কিছু ওষুধের দাম এমন অবস্থায় যেতে পারে যে, সব মানুষের পক্ষে সব ওষুধ কেনা সম্ভব না-ও হতে পারে, এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
দেশে ওষুধ তৈরিতে বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল ব্যবহার হচ্ছে। এ কাঁচামালের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি হয়। দেশে কাঁচামাল তৈরির জন্য যে শিল্পাঞ্চল (এপিআই পার্ক) গড়ে তোলা হচ্ছে, সেখানে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব আছে। ফলে এর টেকসই হওয়া নিয়েও আছে সংশয়। পর্যাপ্ত গবেষণার অভাবের ফলে এ শিল্পের প্রসার ব্যাহত হচ্ছে। দেশে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনের লক্ষ্যে ২০০৮ সালে সরকার অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট (এপিআই) বা ঔষধ শিল্প পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিসিককে। ২০০৮ সালে এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরে চার দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। অথচ ১৬ বছরেও কোনো কারখানা এখনো উৎপাদন শুরু করতে পারেনি এ শিল্পপার্কে।
জাতীয় পর্যায়ে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির গবেষণা প্রতিষ্ঠান এখনো নেই, যা ভারত ও অন্যান্য দেশে কয়েক দশক আগেই প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরি হলে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জেনেরিক ড্রাগগুলোর কাঁচামাল তৈরির প্রযুক্তি ও পদ্ধতি সহজেই ডেভেলপ করতে পারত এবং স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে পারত। পাশাপাশি গ্যাস-পানি ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বর্তমানে প্রায় হাজার কোটি টাকার ওষুধের চোরাচালান হয়, তা বন্ধ করতে হবে। আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। যে কোনো শিল্প প্রসারের ক্ষেত্রে গবেষণা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো প্রতি বছর গড়ে ১৩৫ বিলিয়ন ডলার গবেষণা খাতে খরচ করে থাকে। যেসব দেশের গবেষণা যত উন্নত, সেসব দেশে শিল্পের প্রসার তত বেশি। তাই শিল্পকে এগিয়ে নিতে গবেষণার পরিধি আরও বাড়াতে হবে। যদিও এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ঔষধ শিল্প খাতে মেধাবী ও কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদের প্রবেশ ঘটছে।
বর্তমানে ওষুধ রপ্তানি করছে বাংলাদেশের ৪০টি প্রতিষ্ঠান। তবে এর অধিকাংশই যাচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতির পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোতে কিভাবে রপ্তানি বাড়ানো যায়, সেই পথ খুঁজে বের করা দরকার। তবে নজরদারির অভাবে নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করে বাজারজাত করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। আমরা জানি, সরকারের উদ্যোগে আধুনিক মেশিনারিজ স্থাপন ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না এর ফলে সব ধরনের ওষুধের পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের জন্য ল্যাবরেটরির সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ওষুধের ওপর নিঃসন্দেহে আরও আস্থা বাড়বে। একই সঙ্গে রেগুলেটেড মার্কেটে বাংলাদেশের ওষুধের বাজার প্রসারিত হবে। ওষুধ উৎপাদনের জন্য দেশে কাজ করে যাচ্ছে দুই শতাধিক ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি। এসব কোম্পানিতে প্রতি বছর ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদিত হয়ে থাকে। ওষুধ উৎপাদনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন দুই লাখের অধিক কর্মী। আশা করা যায়, ওষুধ রপ্তানি কয়েক বছর পর পোশাক রপ্তানিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
রপ্তানি প্রক্রিয়ায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করতে অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এই শিল্পের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করে, স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।

লেখক : কর্মকর্তা, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড

×