![বায়ুদূষণ রোধে চাই কার্যকর পদক্ষেপ বায়ুদূষণ রোধে চাই কার্যকর পদক্ষেপ](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/26-2502071432.jpg)
বসবাসের অনুপযুক্ত শহর হিসেবে খ্যাত ঢাকা সারা বছরই বায়ুদূষণে জর্জরিত থাকে। বাতাসের মান পর্যবেক্ষণকারী সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) পর্যবেক্ষণে বিশ্বে ঢাকা প্রায় প্রতিদিনই শীর্ষ অবস্থানে থাকছে। শীত এলে বায়ুদূষণের সমস্যা যেন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়। এর অন্যতম কারণ হলো কম বৃষ্টিপাত আর শুষ্ক আবহাওয়া। পাশাপাশি ইট-ভাঁটি, শিল্প-কারখানা, যানবাহনের ধোঁয়া, বিভিন্ন উন্নয়ন ও নির্মাণ এলাকার ধুলো এবং জৈব জ্বালানি ও বর্জ্য পোড়ানো ইত্যাদি বাতাসের মানকে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর করে তুলছে।
এ ছাড়াও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বায়ুদূষণের আরও কিছু কারণ হলো সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, রাস্তা নির্মাণ, পুনর্র্নির্মাণ ও মেরামত, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, সেবা সংস্থাগুলোর নির্মাণকাজ ও বড় উন্নয়ন প্রকল্প (যেমন এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল), সড়ক বা মহাসড়কের পাশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বালু উত্তোলন ও সংগ্রহ, ট্রাক বা লরিতে বালু, মাটি, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় পরিবহন, ড্রেন থেকে ময়লা তুলে রাস্তায় ফেলে রাখা, ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে গিয়ে ধুলাবালি ছড়ানো, ফুটপাত ও রাস্তার আইল্যান্ডের মাঝের ভাঙা অংশের মাটি ও ধুলা, বিভিন্ন যানবাহনের চাকায় লেগে থাকা কাদামাটি, বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল ও বাণিজ্যিক ভবনের আবর্জনা ও ধুলাবালি রাস্তায় ফেলা, হাসপাতালের বর্জ্য রাস্তায় ফেলা, অধিক সালফারযুক্ত ডিজেল ব্যবহার এবং জনসচেতনতার অভাব ইত্যাদি।
বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণ জলবায়ুর পরিবর্তনকে বেগবান করছে। মানবসৃষ্ট কারণে বাতাসে প্রচুর পরিমাণে ব্ল্যাক কার্বন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন (সিএফসি) ও ওজন (ঙ৩) গ্যাস নির্গত হচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে জলবায়ু প্রভাবিত হচ্ছে। বায়ুদূষণে দায়ী গ্যাসগুলো সূর্য থেকে আসা তাপ ধরে রাখে। এ ছাড়া তাপ বিকিরণ করে পৃথিবীর ঠান্ডা হওয়ার ক্ষেত্রে এসব গ্রিন হাউস গ্যাস বাধাগ্রস্ত করে। ফলস্বরূপ পৃথিবীর উষ্ণতা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। যার মাঝে রয়েছে ধূলিঝড়, সাইক্লোন, বন্যা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অতিবৃষ্টি ও খরা ইত্যাদি।
ব্যাপক বায়ুদূষণ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন নগরাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সারাবিশ্বে প্রতি দশ জনের নয় জন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেন। এর ফলে প্রতি বছর প্রধানত মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘হেলথ অ্যাফেক্টস ইনস্টিটিউট’ এবং ‘ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড এভ্যালুয়েশন’ বাতাসের মানের ভিত্তিতে এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর এশিয়ার দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে শীর্ষ অবস্থানে। বিশেষ করে বেশি বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে রাজধানী ঢাকার মানুষ। দূষিত বায়ুর কারণে মানুষ নানা ধরনের সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের ফলে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া শহরের মানুষের যেমনি রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি সম্ভাবনা বাড়ছে কিডনি বিকল হওয়ার। প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে আর সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে চোখের এলার্জি। বায়ুদূষণের কারণে পরিবেশগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ার ফলে নারী এবং শিশুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। একদিকে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের মানসিক অবসাদ বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী এক্ষেত্রে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দরিদ্র দেশ, কম বয়সী শিশু ও বয়স্করা। প্রতিনিয়ত শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের রক্তে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম ও সীসা প্রবেশ করছে এবং এর ফলে মস্তিষ্কের কোষের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া বা ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দূষিত বায়ুর কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু সাত বছর কমেছে এবং শুধু রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের গড় আয়ু আট বছর হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া বায়ুদূষণের কারণে মানুষের ফুসফুসের কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে মানুষের কর্মদক্ষতা। এসকল কারণে কমে যাচ্ছে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হার এবং বাড়ছে অর্থনৈতিক ক্ষতি। বাংলা এবং ইংরেজি নতুন বছর এলেই মানুষ তা উদযাপন করতে প্রচুর পটকা ও আতশবাজি ফোটায়। তাতে ব্যাপক শব্দ এবং বায়ুদূষণ হয়। শহর অঞ্চলের মানুষের মাঝে নববর্ষে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো একটি প্রচলিত উৎসবে পরিণত হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর আতশবাজি ও পটকা ফোটানোর কারণে জীববৈচিত্র্য যেমন ঝুঁকির সম্মুখীন হয় তেমনি মানুষের এ ধরনের অসচেতনতা, অবহেলার কারণে শহরের বাস্তুসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পশুপাখির জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ছে এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা কষ্ট পাচ্ছে। এমনকি প্রচণ্ড শব্দের কারণে দুর্বল হৃদপিণ্ডের শিশু ও বয়স্ক মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
বায়ুদূষণের কারণে যে এত সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা সমাধানে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। প্রতি বছর বায়ুদূষণের কারণ, ক্ষতির প্রভাব ও প্রতিকার নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে নানা ধরনের তথ্য ও প্রতিবেদন উঠে আসে কিন্তু বায়ুদূষণ রোধে সন্তোষজনক এবং দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় না। নববর্ষের রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা যতটা হতাশাজনক, সাধারণ মানুষের অসচেতনতা তারচেয়ে বেশি হতাশাজনক। এ অবস্থায় যদি বায়ুদূষণ চলমান থাকে তবে অচিরেই নগরবাসীর জন্য বুক ভরে শ্বাস নেওয়াই কঠিন হয়ে যাবে। শহর অঞ্চলের সবাই বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস গ্রহণ করতে চায় কিন্তু সবার মাঝে এ বিষয়ে কাজ করার ইচ্ছে ও সহযোগিতামূলক মনোভাবের অভাব রয়েছে।
বায়ুদূষণ রোধে সরকারকে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি বায়ুদূষণের সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে সর্বস্তরের মানুষকে সহজ ভাষায় বোঝাতে হবে যেন তারা নিজ উদ্যোগেই সচেতন হয়। কেননা সকলের সার্বিক অংশগ্রহণ ব্যতীত সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সাফল্য প্রত্যাশা করা যাবে না। আমরা যদি বায়ুদূষণ রোধে কঠোর অবস্থানে না যেতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে জলবায়ুর পরিবর্তন একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আন্তর্জাতিক তহবিলের মাধ্যমে বায়ু বিশুদ্ধকরণ প্রকল্পে বাংলাদেশ যে আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। আবার যতটুকু তহবিল পাচ্ছে সেটার ফলাফলও প্রত্যাশার বাইরে। এতে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বছর বছর পরিবেশ দূষণরোধ সংক্রান্ত দিবস এলে এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হয় কিন্তু কার্যত কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই। বছরের পর বছর আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতার কারণে কোনো পরিকল্পনাই আশার আলো দেখছে না। নীরব ঘাতক বায়ুদূষণের ব্যাপারে এখনই সোচ্চার হতে না পারলে স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক খাতে ভবিষতে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে। তাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকরা নির্মল বায়ু আইন বাস্তবায়নে কাজ করবেন এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী কাজ করতে উদ্যোগী হবেন।
লেখক : রিসার্চ অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার, এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, বাংলাদেশ আরবান হেলথ নেটওয়ার্ক