![শিশুশিক্ষা কতটুকু জলবায়ু ঝুঁকিমুক্ত শিশুশিক্ষা কতটুকু জলবায়ু ঝুঁকিমুক্ত](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/25-2502071429.jpg)
করোনা মহামারিকালে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা কার্যক্রম প্রচণ্ড ঝুঁকি মোকাবিলা করেছে। মৃত্যুর মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ জীবনযাত্রা নিশ্চিতকল্পে লকডাউনসহ নানা কারণে পৃথিবী ছিল বিপর্যস্ত। করোনার দোর্দণ্ড প্রভাবে কল্পনাতীত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল শিক্ষাসহ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের সব খাত। সকল স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম শুধু ব্যাহত হয়নি; কিছুকাল ধরে তার অব্যাহত আঘাত পরিলক্ষিত। ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে দেড় বছর বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও দীর্ঘসময় স্কুল বন্ধ থাকার ফলে, শিক্ষার্থীদের অনেকেই দারিদ্র্যের করুণ অভিশাপে বিভিন্ন কর্মে জড়িয়েছিল। অনেক কোমলমতি মেয়েকে তাদের পরিবার কর্তৃক জোরপূর্বক বাল্যবিয়ে সম্পন্নে বাধ্য করা হয়েছিল। প্রায় প্রতিটি দেশেই যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে কালক্ষেপণের চৌহদ্দী কারও জানা নেই। করোনা অতিক্রান্তে জীবনপ্রবাহের সচলতা চলমান থাকলেও যুদ্ধ-বিগ্রহ, খরা-বন্যা, অতি-অনাবৃষ্টি, দাবদাহসহ নানামুখী মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে বহুদেশ ক্ষত-বিক্ষত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা উপত্যকায় গণহত্যাসহ বহুমুখী ঘটনা-দুর্ঘটনায় জনজীবন এখনো দুর্বিষহ। বাংলাদেশে জুলাই ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর প্রাণ বিসর্জন ও আহতদের আহাজারিতে সৃষ্ট ট্রমায় এখনো শিক্ষার্থীরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে আক্রান্ত।
সমকালীন বিশ্বব্যবস্থায় সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। বৈশ্বিক উষ্ণতার নেতিবাচক প্রভাবে উন্নত-উন্নয়নশীল-অনুন্নত বিশ্বের সামগ্রিক সামাজিক-প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ চরম বিপন্নতায় পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছে। জীববৈচিত্র্য-জীবন জীবিকার প্রাত্যহিক গতিময়তা সত্যের কাঠিন্যে ভয়াবহ সমস্যায় নিপতিত। নানামুখী গবেষণার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ-তথ্য উপাত্ত-পরিসংখ্যান প্রতিবেদন প্রকৃত অর্থেই ধরিত্রীর সকল নাগরিকের হৃদয় গভীরে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আজানা আশঙ্কা-আতঙ্কের দুর্ভেদ্য প্রাচীর নির্মিত হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের পর্যবেক্ষণ-মতামত-ভবিষ্যদ্বাণী পুরোবিশ্বকে প্রতিনিয়ত নবতর প্রকরণে পরিবেশের সকল উপাদানের পরিবর্তনশীল গতিধারা সম্পর্কে প্রচণ্ড কৌতূহলী করে তুলছে। পরিত্রাণের সুগম পন্থা উদ্ভাবনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের পক্ষ থেকে করুণ আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হলেও তা কোনোভাবে উন্নত বিশ্বের কর্ণগোচরে আসছে বলে মনে হচ্ছে না। সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুত বিষয়সমূহের প্রতি চরম অবজ্ঞা-অমনোযোগ বিবেকপ্রসূত বিশ্ববাসীকে যারপরনাই হতবাক করছে।
ইতোমধ্যেই বাংলাদেশসহ ধরিত্রীজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক ঝুঁকিতে জনদুর্ভোগ অতি উঁচু মাত্রিকতায় পৌঁছেছে। খাদ্য উৎপাদন-বিতরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘর-বাড়ি, পশুপালন প্রতিটি ক্ষেত্রই বারবার জলবায়ু ঝুঁকিতে পড়ছে। সবচেয়ে যেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলোÑ আগামী প্রজন্ম যেসব সমস্যায় নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে, তার মধ্যে শিশুশিক্ষা কার্যক্রম অন্যতম। অতিসম্প্রতি জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বাংলাদেশ প্রকাশিত ‘লার্নিং ইন্টারাপটেড : গ্লোবাল স্ন্যাপশট অব ক্লাইমেট-রিলেটেড স্কুল ডিসরাপশন ইন ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার প্রভাবে ২০২৪ সালে বিশ্বে স্কুলগামী প্রায় ২৪ কোটি ২০ লাখ শিশুর পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়েছে। ৮৫টি দেশের স্কুল শিক্ষার্থীদের প্রতি সাতজনে প্রায় একজন চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার শিকার। তন্মধ্যে সাড়ে তিন কোটি শিশুই বাংলাদেশের। আগামী বছরগুলোতে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু সংকটের ফলেই শিক্ষায় এমন প্রভাব পড়ছে। এর মধ্যে তাপপ্রবাহই অন্যতম। ভয়াবহ তাপপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশ, কলম্বিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড ও ফিলিপিন্সে শুধু এপ্রিল মাসেই ১১ কোটি ৮০ লাখ শিশুসহ ঐ বছর অন্তত ১৭ কোটি ১০ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে ফিলিপিন্সে শিশুদের হাইপারথার্মিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বাইরে থাকা হাজারো স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, জলবায়ু ও পরিবশে ক্ষতির উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে বাস করে প্রায় ১০০ কোটি শিশু যা বিশ্বের মোট শিশুর অর্ধেক।
উক্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিগত বছরে এপ্রিল ও মে মাসে বাংলাদেশজুড়ে তাপপ্রবাহ শিশুদের পানিশূন্যতা ও হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি করে। ফলে, সারাদেশে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত স্কুল ছুটি দিতে বাধ্য হয়। মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে কিছু জেলায় শিশুদের স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এরপর জুনে হওয়া তীব্র বন্যার ফলে শিশুদের শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বন্যায় সারাদেশে প্রায় ১ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল ৭০ লাখ। সিলেট জেলায় ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপকভাবে অবকাঠামোর ক্ষতি হলে ছয় লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ে। সংস্থাটির হিসেবে ২০২৪ সালের ১২ মাসের মধ্যে জলবায়ুজনিত কারণে সিলেট অঞ্চলে শিশুরা সব মিলিয়ে আট সপ্তাহ পর্যন্ত স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ইউনিসেফের আশঙ্কা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু সংকটের পেছনে দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ বর্তমান হারে অব্যাহত থাকলে ২০০০ সালের তুলনায় আটগুণ শিশু ২০৫০ সালে তাপপ্রবাহের শিকার হবে। এ ছাড়া একই সময় ব্যাপক বন্যার ক্ষতিতে পড়তে পারে তিনগুণের এবং দাবানলের প্রভাবে পড়তে পারে এক দশমিক ৭ গুণ বেশি শিশু।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, দশকের পর দশক জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারসহ মানুষের নানা রকম কর্মকাণ্ড এই পৃথিবীকে উষ্ণ করে তুলছে এবং আবহাওয়ার রূপ বদলে দিয়েছে। গত বছর বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে প্রথমবারের মতো এটি সাময়িকভাবে হলেও ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণায়নের প্রান্তসীমা অতিক্রম করেছে। আবহাওয়ার এ অবস্থায় বর্ষা মৌসুমে আগের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত ও গ্রীষ্মকালে বেশি শুষ্কতা দেখা যাচ্ছে। তা ছাড়া বাড়ছে তাপপ্রবাহ ও ঝড়। ফলে, লোকজন আরও বেশি দুর্যোগের ঝুঁকিতে পড়ছে। প্রাসঙ্গিকতায় ইউনিসেফ প্রতিনিধি বলেন, ‘চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনাবলির তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা বারবার আঘাত হানার প্রবণতাও বেড়েছে। জলবায়ু সংকট এটাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এগুলোর সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের শিশুদের শিক্ষার ওপর এবং শিশুরা তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চরম তাপমাত্রা ও অন্যান্য জলবায়ুজনিত সমস্যা শুধু শিশুদের স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমই ব্যাহত করে না, বরং এ কারণে শিশুদের মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং মানসিক-শারীরিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বড় সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকলে শিশুদের বিশেষ করে কন্যাশিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার সুযোগ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বৃদ্ধি পায় পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে বাল্যবিয়ের ঝুঁকির হার।’ সংস্থাটির চিলড্রেন’স ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (শিশুদের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি সূচক) অনুযায়ী, জলবায়ু ও পরিবেশগত সংকটের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের শিশুরা। এসব নিয়মিত দুর্যোগে দেশে ‘শিখন দারিদ্র্য’ (১০ বছর বয়সেও সহজ কোনো লেখা পড়তে না পারলে অথবা পড়ে বুঝতে না পারলে শিক্ষার্থীদের সেই অবস্থাকে শিখন দারিদ্র্য বলে) দিন দিন আরও ব্যাপক হয়ে উঠেছে। দেখা গেছে, স্কুলগামী শিশুদের প্রতিদুজনে একজন তার ক্লাস অনুসারে যতটুকু পড়তে পারার কথা, তা পারছে না। আবার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পরও দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী মৌলিক গণনা পারে না। উপরন্তু অনেক তুখোড় মেধাবী মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে স্কুল থেকে অকালে ঝরে পড়ছে। বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে রয়েছে, সেসব দেশের তালিকায় প্রথম ১০টির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে আরও উপস্থাপিত যে, এসব প্রভাব থেকে শিশুদের সুরক্ষার জন্য স্কুল ও শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে এবং শিক্ষায় জলবায়ুকেন্দ্রিক বিনিয়োগ লক্ষণীয়ভাবে কম। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইউনিসেফ আন্তর্জাতিক জলবায়ু খাতে অর্থদানকারী প্রতিষ্ঠান, দাতাগোষ্ঠী, বেসরকারি খাতসহ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি নীতিপরিকল্পনায় শিশুদের প্রয়োজনীয়তাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় শিক্ষা খাতে অর্থায়নের বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য এককালীন সাড়ে ১৮ মার্কিন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে কিছু কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যÑ হলো শ্রেণিকক্ষের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য অভিযোজন ব্যবস্থা। এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সংকট তৈরি হচ্ছে, তা আরও বেড়ে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে শিক্ষার জন্য বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবন করা জরুরি। সরকারগুলোকে শিক্ষা খাতের সঙ্গে জলবায়ুবিষয়ক নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সঠিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলা করতে পারে। সার্বিক পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। উদ্ভূত সমস্যাসমূহের সম্ভাব্য বিবেচনায় এখন থেকে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের রোডম্যাপ জরুরি। অন্যথায় সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কালক্ষেপণ না করে প্রায়োগিক কর্মকৌশলের দৃশ্যমানতা সময়ের জোরালো দাবি।
লেখক : শিক্ষাবিদ