ফেব্রæয়ারি এলেই ঢাকার বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এক ভিন্ন আবহে সেজে ওঠে। সারাদেশের পাঠক, লেখক, প্রকাশক এবং সংস্কৃতিমনা মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে প্রাণের মেলাÑ অমর একুশে বইমেলা। একদিকে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী মাস, অন্যদিকে নতুন বইয়ের ঘ্রাণÑ এই দুইয়ের সমন্বয়ে একুশে বইমেলা হয়ে ওঠে বাঙালির আবেগের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধু বই কেনা-বেচার মেলা নয়, বরং এটি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির এক বিশাল উৎসব, যেখানে কেবল পাঠক-লেখকদের মিলনই ঘটে না, বরং একটি জাতির সৃজনশীলতা ও মননশীলতার প্রতিফলন ঘটে।
একুশে বইমেলার শুরুটা হয় বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের চেতনা থেকে। ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে এর সূচনা হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এটি নিয়মিত রূপ পায় ১৯৭৮ সালে। ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে সামনে রেখে এ মেলার বিস্তৃতি ঘটে ধাপে ধাপে। আর এখন এটি শুধু বাংলাভাষী মানুষের জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সংস্কৃতিরও এক অনন্য প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর ফেব্রæয়ারিজুড়ে চলা এই মেলা কেবল বই প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং লেখক-পাঠকের সরাসরি সংযোগ স্থাপনের সুযোগ তৈরি করে। এখানে প্রতিদিনই নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়, সাহিত্য আড্ডা বসে, আলোচনা সভা হয়, যেখানে সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে মতবিনিময় চলে। ফলে একুশে বইমেলা হয়ে উঠেছে এক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কেন্দ্র, যেখানে নতুন প্রজন্মের লেখকরা নিজেদের সৃজনশীলতা তুলে ধরার সুযোগ পান।
বইমেলার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি কেবল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আয়োজিত মেলা নয়, বরং একটি আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা। একুশে ফেব্রæয়ারির আত্মত্যাগের চেতনাকে ধারণ করেই এই মেলা গড়ে উঠেছে, যেখানে ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি মানুষের ভালোবাসা গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়। এখানে নানা ধরনের বই প্রকাশিত হয়Ñ কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা, শিশুতোষ সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাসসহ নানা বিষয়ে বই পাওয়া যায়। ফলে পাঠকের চাহিদা ও রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেলাটিও ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে।
বইমেলা শুধু শহরের নয়, সারাদেশের পাঠকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাঠকরা তাদের প্রিয় লেখকের নতুন বই সংগ্রহ করতে ভিড় করেন। তরুণ লেখকদের জন্য এটি বিশেষ সুযোগ এনে দেয়। কারণ তারা সরাসরি পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানতে পারেন। পাঠক-লেখকের এই মেলবন্ধন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি নতুন লেখকদের আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রও প্রসারিত করে। বিশেষ করে নতুন প্রকাশনাগুলো এই মেলার মাধ্যমেই পাঠকদের কাছে পরিচিতি লাভ করে।
এ মেলায় প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে সাহিত্যিক মান নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়। অনেকেই বলেন, মেলায় বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছুটা বাণিজ্যিক মনোভাব কাজ করে। ফলে অনেক বই কাক্সিক্ষত মান ধরে রাখতে পারে না। এটি যেমন সত্য, তেমনি এটিও সত্য যে, বইমেলা না থাকলে নতুন লেখকদের জন্য প্রকাশনার সুযোগ সীমিত হয়ে যেত। তাই একদিকে যেমন গুণগত মান বজায় রাখা জরুরি, তেমনি নতুন লেখকদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম নিশ্চিত করাও প্রয়োজন।
বইমেলার পরিবেশ প্রতিবছরই উন্নত হচ্ছে। বাংলা একাডেমি ও সরকার মেলার সার্বিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। মেট্রোরেলে যাতায়াত, ই-টিকেটিং, ডিজিটাল ক্যাটালগ, মোবাইল অ্যাপসহ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পাঠকদের জন্য মেলায় আসা আরও সহজ ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পাশাপাশি নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা পাঠাগার, প্রবীণদের বসার ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ খাবার ও বিশ্রামের জায়গা যুক্ত হওয়ায় মেলার পরিবেশ আরও মনোরম হয়ে উঠেছে।
একুশে বইমেলা কেবল একটি বা দুটি প্রজন্মের জন্য নয়, এটি বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। এটি শুধু বই কেনা-বেচার স্থান নয়, বরং এটি একটি চেতনার নাম, যা আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে। বাংলা ভাষার বিকাশ, নতুন লেখকদের উত্থান, পাঠকদের বইয়ের প্রতি ভালোবাসাÑ সবকিছু মিলিয়ে এই মেলা হয়ে উঠেছে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের সাহিত্যের পথচলা সমৃদ্ধ করে চলেছে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ