![তরুণ সমাজের প্রতি প্রবীণদের দায়িত্ব তরুণ সমাজের প্রতি প্রবীণদের দায়িত্ব](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/15-2502061309.jpg)
বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, মানুষের সভ্যতার পরতে পরতে যে সকল যুগ প্রবর্তক ঘটনা, তার প্রায় অধিকাংশরই হোতা তরুণরা। মনীষী বার্নাডার্স একবার বলেছিলেন, ‘নতুন কিছু করাই তারুণ্যের ধর্ম। ইউরোপের রেনেসাঁ, ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লবের ইতিহাস পর্যালোচনায় তারুণ্যের শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের কথাই ধরা যাক, দেশের তরুণ সমাজ তখনকার সময়ে যে ভূমিকা রেখে ছিল তা আমরা সকলেই জানি। তরুণ সমাজের ঝড়োগতির ফসল বলা যেতে পারে স্বাধীনতাকালীন সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। দেশকে শত্রুমুক্ত করার সেই ক্রান্তিকালে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকরা অকাতরে ঢেলেছে বুকের তাজা রক্ত। তরুণদের অদম্য সাহসের জোরে, দেশবাসীর দেশের জন্যে মমত্ববোধ প্রবল নাড়া দেওয়ার কারণে আমরা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি স্বাধীনতার লাল সূর্য। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে এ পর্যন্ত যতো বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম র দেশের ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায় হয়ে আছে সবকিছুর নেতৃত্বদানকারীরা হলো আমাদের এ দেশের যুব সমাজ।
অমিততেজা আমাদের তারুণ্য আজ বড়ই বেকায়দায়। তারা উত্তরণের পথ খ্ুঁজে না পেয়ে পা বাড়াচ্ছে সর্বনাশা পথে। যে হতে পারতো বরেণ্য কোনো ব্যক্তি সে হারিয়ে যাচ্ছে কৃত্রিম কোলাহলে। যে হাতে শোভা পেতো কলম, আজ সে হাতে উঠছে অস্ত্র। যে যুবক সমাজে পারতো সৌরভ ছড়াতে, আজ সে কলংকিত। চাঁদাবাজি, মাস্তানি সবকিছুই আজ কিছু শ্রেণির যুবকরা করছে। অবৈধ মাদকদ্রব্য এবং চোরাচালানির গডফাদাররা নেপথ্যে থেকে ব্যবহার করছে তরুণদের। ঘরে বাইরে সবখানেই একই অবস্থা বিরাজমান। কেনো এমন হলো এর কারণ অনুসন্ধান করা অভিজ্ঞমহলের প্রাণের দাবি।
আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন- তারুণ্য আলোর গানের, তারুণ্য কল্যাণের। হয়তো এ কারণে তারুণ্য সবসময় ন্যায় ও সত্যের জন্য পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। আমাদের দেশের তারুণ্যরা সব সময় সচেতন। এই সচেতনতাকে যদি দরদ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে ব্যবহার করা যায় তাহলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। এই সমাজ কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে স্রোতের পানির মতো বহমান থাকতো। কিন্তু আমাদের অপরিকল্পিত রাজনীতি সেই অধ্যায় আলোকিত না করে ছুটছে ভিন্ন পথে। রাজনৈতিক কারণের পাশাপাশি আরও কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ বিদ্যমান যুব সমাজকে ধ্বংসের মূলে। বয়সের কারণে তারুণ্য একটু বেশি আবেগময় এবং উচ্ছ্বাস প্রবণ। তারুণ্য কিছু একটা করতে চায়। সকল পুরনোকে পেছনে ফেলে নতুন জীবন আচ্ছাদনে হয়ে পড়ে মশগুল। অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চায় নবো নবো আঙ্গিকে। কবির ভাষায় তারুণ্য হলো ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, আকাশের মতো বাধাহীন। এ সমস্ত সার্বিক কারণে তরুণরা ভালোবাসতে শিখে, নানা রঙিন স্বপ্নে বিভোর থাকে সারাক্ষণ। সে অভিমান প্রিয় কল্পনাবিলাসী। কিন্তু আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে তারুণ্যকে তো যথাযথভাবে কাজে লাগাচ্ছি না, উল্টো তারুণ্য যাতে ভালো কিছু করার সুযোগ না পায় সে ব্যবস্থা করছি। তারুণ্যকে নানাভাবে আটকিয়ে সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত না হওয়ার অন্তরায় সৃষ্টি করা হচ্ছে।
ফলে অবরুদ্ধ তারুণ্য বিকল্প পথ খুঁজে। তারুণ্যের এ গতির কারণে সমাজ তথা দেশে অশান্তির দামামা বেজে ওঠে। দেশ যখন অস্থিরের শেষ সীমানায় উপনীত হয় তখন তৃতীয় শক্তির তৎপরতা বেড়ে যায়। সুযোগকে কাজে লাগায় অপশক্তির লোকেরা। তারা তরুণদের ছলেবলে কৌশলে নিজেদের করে নিয়ে হাতে গুজে দেয় কড়কড়ে নতুন নতুন টাকার নোট। নতুন টাকার সুবাসে তারুণ্য সুরক্ষিত হয়ে অধিক সুখ আহলাদে বিভোর হয়ে পড়ে। তখন তারা কি করছে তারাই বুঝতে পারে না। নেশায় ডুবে ভুলে থাকতে চায় অশান্তির যতো যাতনা। শুরু হয়ে যায় আইন হাতে তুলে নেওয়ার মতো ঘটনা। তারা হারিয়ে ফেলে মমত্ববোধ, শ্রদ্ধাবোধ কি জিনিস তা তারা বেমালুম ভুলে যায়। সামাজিক রাজনীতি তারা মানে না। ব্যথিতদের দুঃখে তারা ব্যথিত হয় না। প্রচলিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা উদ্দেশ্য হাসিলের পথে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও আমাদের তরুণ শক্তিকে ক্ষমতায় রাখতে পারছে না। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে রাজনৈতিক হিংস্র তৎপরতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক প্রকার অস্থিরতায় ভুগছে। পরীক্ষায় দুর্নীতি, সেশনজট, দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব সবকিছু কলেজকে করছে কলুষিত। এরকম একটা অবস্থায় আশা, আশ্রয় ও আশ্বাসের জন্য যেই তারুণ্য আশায় বুক বাঁধছে সে হয়ে পড়ছে নিজস্ব গৌরবময় ঐতিহ্যের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন। টালমাতাল অবস্থায় সূতা ছেড়া ঘুড়ির মতো তারুণ্যকে উড়িয়ে নিচ্ছে নীল আকাশের অনন্ত ঠিকানায়। যেখানে নেই চলার শেষ, আসা যায় না ফিরে। ধ্বংস অনিবার্য, সে রকম একটা নিদিষ্ট জায়গা। তারুণ্য কিন্তু পিছু ফিরতে চায়, পিছু ডাকের অপেক্ষায় থাকে, ডাক পায় না বলে আর ফিরে আসতে পারে না। এর জন্যে তো পরোক্ষভাবে আমরাই দায়ী। কেউ তাকে অনুপ্রাণিত করছে না, আশার বাণী শোনাচ্ছে না। কি চায় সে তা আমরা আমলে নিতে চাই না। অভিমান সকলেই করে। তারুণ্যের অভিমান ভাঙার কেউ নেই। এতে ঘটছে নানা বিপত্তি। তাই বলতে চাই- সৎ মানসিকতায় এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের রক্ষায় প্রবীণদের।
লেখক : সাংবাদিক