![মণিপুরীদের তাঁতের শাড়ি মণিপুরীদের তাঁতের শাড়ি](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/14-2502061304.jpg)
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও যুদ্ধজনিত কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের অধিবাসীরা বিভিন্ন সময় দেশত্যাগ করে। তখন অনেকে পাকিস্তান-ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নেয় তারা। তাদের মধ্যে বার্মা (মিয়ানমার)-মণিপুর যুদ্ধের সময় (১৮১৯-১৮২৫) তৎকালীন মণিপুরের রাজা চৌরজিৎ সিংহ, তার দুই ভাই মারজিৎ সিংহ ও গম্ভীর সিংহসহ আশ্রয় গ্রহণ করেন বৃহত্তম সিলেট অঞ্চলে। বর্তমানে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় মণিপুরী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। এখন দেশে যে কয়টি নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম মণিপুরী সম্প্রদায়। ভাষাগত এবং ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশে মণিপুরীরা তিনটি শাখায় বিভক্ত। বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও পাঙন। এর মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়ার সংখ্যাই বেশি। বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ হিন্দুধর্মে এবং পাঙনরা মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসী। সব মিলিয়ে জনসংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। শাখা তিনটি হলেও সব মণিপুরীদের প্রায় একই সংস্কৃতি। তাদের ভাষা, বর্ণমালা, সাহিত্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এদেশে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা।
মণিপুরীরা বুনন শিল্পে খুবই দক্ষ। নিজেদের কাপড় তারা নিজেরাই বোনে। তাই প্রায় প্রতিটি মণিপুরী ঘরেই তাঁত রয়েছে। প্রবাদ আছে- মণিপুরী মেয়েরা জন্মসূত্রেই তাঁতী এবং প্রায় ৯০ শতাংশ মণিপুরী নারী তাঁতের সঙ্গে যুক্ত। মণিপুরীদের উৎপাদিত তাঁত পণ্যের মধ্যে রয়েছেÑ ফানেক (মণিপুরীদের বিশেষ এক ধরনের পোশাক), শাড়ি, বিছানার চাদর, শাল, ওড়না, গামছা, থ্রি-পিস ইত্যাদি। অবশ্য মণিপুরীদের শাড়ি বুননের প্রচলন অন্যান্য বুননের কিছুটা পরে শুরু হয়েছে এবং ধীরে ধীরে এই শাড়ি জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।
মণিপুরী ভাষায় তাঁতকে বলে ‘ইয়োং’। ইয়োং আবার দুই ধরনের। খোয়াং ও পাং। খোয়াং বা কোমর তাঁতে ফানেক, বিছানার চাদর, শাল ইত্যাদি তৈরি হয়। এই তাঁতে সাধারণত মোটা সুতার কাপড় তৈরি করা হয়। অন্যদিকে, পাং অনেকটা চিত্তরঞ্জন তাঁতের মতোই। তবে গঠন প্রণালীতে কিছুটা পার্থক্য আছে। বর্তমানে মণিপুরীরা বেশিরভাগ পাং ব্যবহার করছে। এই তাঁতে মণিপুরী শাড়ি, বিছানার চাদর, গামছা, ওড়না, ফানেক ইত্যাদি কাপড় বোনা যায়। এই তাঁতে সাধারণত চিকন সুতার কাপড় তৈরি করা হয়।
এক সময় নিজেদের প্রয়োজনে মণিপুরীরা তাঁতের কাপড় বুনলেও ধীরে ধীরে এটি বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে মণিপুরী শাড়ির বাজার বেড়েছে। মণিপুরীরা ফানেক, বিছানার চাদর, শাল, গামছা বুনে থাকলেও এখন বেশিরভাগ মণিপুরী তাঁতি বুনছে শাড়ি। কারণ, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে মণিপুরী শাড়ি এখন যে কোনো সম্প্রদায়ের ফ্যাশন সচেতন নারীর কাছে পছন্দনীয়। তাই এই শাড়ি বিভিন্ন উৎসব, পার্বণ বা সাধারণ দিনেও পরছেন ফ্যাশন সচেতন নারীরা। বেড়েছে শাড়ির চাহিদাও। তাই মণিপুরী শাড়ি এখন আর কেবল মণিপুরীদের কাছেই নয়, অন্য সম্প্রদায়ের কাছেও সমানভাবে পরিধেয় বস্ত্র।
জামদানি, বেনারসি, টাঙ্গাইল, পাবনা, রাজশাহীরসহ অন্যান্য দেশীয় তাঁতের শাড়িগুলোর প্রতিটির আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, দেখলেই বোঝা যায় এটা কোন তাঁতের শাড়ি। ঠিক তেমনি মণিপুরী শাড়ির রঙ ও নকশা দেখলেও বোঝা যাবে এটা মণিপুরী শাড়ি। কারণ, মণিপুরী শাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য হলো- এর নকশায় মাইরাংগ (টেম্পল) বা মন্দিরের প্রতিকৃতি থাকবে। প্রায় প্রতিটি শাড়ির আঁচল, জমিন ও পাড়ের নকশায় দেখা যাবে এই প্রতিকৃতি। আরও একটি বিশেষ দিক হল, মণিপুরী শাড়ি বরাবরই তৈরি হয় উজ্জ্বল রঙের সুতায়। সুতাগুলো দেশী সুতি ও একটু মোটা মানের। শাড়িগুলো হয় একটু ভারি ও একটু অমসৃণ। অন্যান্য শাড়ির পাড় বিভিন্ন ধরনের হলেও মণিপুরী প্রায় সব শাড়ির পাড়ই চওড়ায় এক থেকে দুই ইঞ্চি হয়ে থাকে এবং এক রঙের। এছাড়া পাড়ের রং প্রায় সব সময় জমিনের রঙের বিপরীত হতে দেখা যায়। এছাড়া আঁচল, জমিন ও পাড়ে মন্দিরের প্রতিকৃতির পাশাপাশি আঁচল ও জমিনে বিভিন্ন নকশা থাকে। যেমন- গোলাপ ফুল, জবা ফুল, বৃত্ত, রেখাসহ বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতি। অনেক আগে থেকেই এসব নকশার প্রচলন চলে আসছে। সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে।
মণিপুরী শাড়ির আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। সেটি হলো- এর পুরো জমিনেই কম-বেশি নকশার ছাপ থাকবে। আগে কিছু কিছু মণিপুরী শাড়ি তৈরি হতো একেবারেই সাদামাটা নকশাবিহীন। সাদামাটা নকশাবিহীন শাড়ি এখন যে একেবারেই তৈরি হচ্ছে না, তা নয়। হাতেগোনা দুই-একজন তাঁতি এখনো সাদামাটা নকশাবিহীন মণিপুরী শাড়ি বুনছেন। তবে তা নিতান্তই নিজেদের প্রয়োজনে বা বিশেষ কাজের জন্য বোনা হচ্ছে। নকশার দিক থেকে মণিপুরী শাড়ির সঙ্গে আমাদের জামদানি শাড়ির একটা মিল আছে। সেটা হলো জামদানি শাড়ির নকশা যেমন অনেকটা সূক্ষ্ম হয়, তেমনি মণিপুরীরাও মণিপুরী শাড়িতে জামদানি শাড়ির মতো সূক্ষ্ম নকশা করতে পছন্দ করে।
বাড়তি শাড়ির চাহিদা কিংবা ফ্যাশন সচেতন নারীর কাছে মণিপুরী শাড়ির প্রতি আগ্রহ থাকার কারণে এ শাড়ির রঙে এবং নকশায়ও ধীরে ধীরে বিবর্তন আসছে। তাই আগের নিয়মে অনেক তাঁতি শাড়ি বুনলেও বর্তমানে কিছু কিছু তাঁতি শাড়ির রং, নকশা, সুতা ও বুননে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা চলছে। চলছে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এরই ধারাবাহিকতায় অনেক মণিপুরী তাঁতি দেশী সুতি সুতার বদলে রাজশাহীর সিল্কের সুতায় মণিপুরী শাড়ি বুনছে। এতে শাড়ির নকশা এক থাকলেও আদলে আসছে ব্যাপক পরিবর্তন। সিল্ক সুতার এই শাড়ি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি মসৃণ ও হালকা। এই সিল্ক সুতার তৈরি মণিপুরী শাড়ি এখন বাজারে জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে ধীরে ধীরে। শুধু সিল্ক নয়, অনেক তাঁতি বিভিন্ন মিশ্র সুতায়ও মণিপুরী শাড়ি বুননের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। একসময় সব দেশী সুতায় বোনা হলেও এখন অনেকে ভারত, কোরিয়াসহ বিভিন্ন বিদেশী সুতায় শাড়ি বুনছে। এছাড়া আগে সুতা শুধু সাদা রঙের পাওয়া গেলেও এখন বাজারে সব ধরনের রঙিন সুতাই পাওয়া যায়। তাই আগের মতো সুতা রঙ করার ঝামেলাও থাকে না।
মণিপুরী শাড়ির বুনন প্রক্রিয়াও অনেকটা আমাদের জামদানি বা দেশী তাঁতের শাড়ির মতো। একটি তাঁতে দুজন তাঁতি কাজ করেন দুই দিকে বসে। প্রথমে সুতা মাড় দিয়ে শুকাতে হয়। তারপর শুকানো সুতা চরকায় পেঁচিয়ে গুঁটিতে ভরে সেখান থেকে মাকুতে নিয়ে বুনতে হয়। আর সবার আগে শাড়ির টানা বাঁধতে হয়। তারপর বুনন কাজ চলে। মণিপুরীদের একটি শাড়ি বুনতে চার থেকে পাঁচদিন সময় লাগে। এর কম-বেশি সময়েও শাড়ি বোনা হয়। তবে শাড়ির রং ও নকশার ওপর নির্ভর করে বোনার সময়। মণিপুরী শাড়ি সাধারণত ৬০০ থেকে সাড়ে চার -পাঁচ হাজার হাজার টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। তবে দাম কম-বেশি নির্ভর করে শাড়ির নকশার ওপর ভিত্তি করে।
সিলেটের বিভিন্ন স্থানে মণিপুরীদের বসবাস হলেও সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মণিপুরী বসবাস করে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায়। মণিপুরী তাঁতিদের অধিকাংশও এই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করছে। এখানকার আদমপুর, তিলকপুর, মাধবপুর, মঙ্গলপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের মণিপুরীদের বাড়িতে বাড়িতে গেলেই দেখা যাবে মণিপুরী তাঁতিদের বুনন ব্যস্ততা। এসব স্থান ছাড়াও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলা ও সিলেটের অন্যান্য অঞ্চলেও মণিপুরী তাঁতিরা রয়েছে। তবে বেশিরভাগের বসবাস এই কমলগঞ্জ উপজেলাতেই।
কয়েক দশক আগেও মণিপুরীরা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই তাঁতে কাপড় বুনত। ধীরে ধীরে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে মণিপুরীরা তাদের তাঁতপণ্য বাণিজ্যিকভাবে বাজারে বিক্রিও করছে। তাই এক সময়কার নিজেদের বুনন ঐহিত্য থাকলেও এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পেশাদারিত্ব মনোভাব ও বাণিজ্যিক চিন্তাধারা। এই বাণিজ্যিক চিন্তাধারা এবং ফ্যাশন সচেতন নারীর চাহিদার জন্যই মণিপুরী শাড়ি এখন দেশের বাজারে বেশ জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়, এই শাড়ি এখন বিক্রি হচ্ছে বিদেশেও। এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোতে মণিপুরী শাড়ি বিক্রি হয়। ঢাকা ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আদিবাসীদের নিজস্ব দোকানগুলোতেও মণিপুরী শাড়ি পাওয়া যায়।
শাড়ির চাহিদা ও গুণগতমান বাড়লেও মণিপুরী তাঁতশিল্প এখনো পুরোটাই চলছে মণিপুরীদের লোকজ্ঞানে। তারা তাঁতের কাজ করছে পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে। অনেক সম্ভাবনাময় একটি শিল্প এই মণিপুরী তাঁতশিল্প। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও দিক নির্দেশনার অভাব। সেইসঙ্গে অভাব রয়েছে তাঁতিদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের। যার মাধ্যমে তাঁতিরা রং, সুতা, শাড়ির বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে এবং আরও ভালোমানের শাড়ির তৈরি করতে পারে। বেশ কয়েক বছর আগে কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরে বিসিকের উদ্যোগে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয় তাঁতি চিত্রা সিংহ জানান, ‘এক সময় নিজেদের প্রয়োজনীয় কাপড়ের জন্যই আমরা তাঁতে কাপড় বুনতাম। কিন্তু এখন এই শাড়ি আমরা ছাড়াও অন্যরাও পরছে। আগের চেয়ে শাড়ির চাহিদাও বাড়ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা এবং পেশাদারিত্ব। কিন্তু সেই তুলনায় আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশিক্ষণ ও দিক নির্দেশনার কমতি রয়েছে।’ মণিপুরী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হামোম তনু বাবু বলেন, ‘বুনন শিল্প মণিপুরীদের ঐতিহ্য। আর এই ঐতিহ্যের একটি- মণিপুরী শাড়ি। মণিপুরী শাড়ির চাহিদা এখন সব সম্প্রদায়ের নারীদের কাছে সমান জনপ্রিয়। এখন এটি আর মণিপুরীদের নিজেদের ঐতিহ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এখন দেশীয় বুনন শিল্পের অন্যতম একটি মাধ্যম। এই শিল্পের আরও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা।’ প্রায় তিন যুগ আগে থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মণিপুরী শাড়িকে বাজারজাত করা হচ্ছে। এখন মণিপুরী শাড়ি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হচ্ছে এবং দিন দিন চাহিদাও বাড়ছে। অন্যান্য তাঁতের শাড়ির মতো মণিপুরী শাড়িও এখন দেশীয় শাড়ির একটি হিসেবে পরিচিত।
লেখক : গবেষক