ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১

সাগরপথে মানবপাচার

প্রকাশিত: ১৮:৪৪, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সাগরপথে মানবপাচার

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ উন্নত জীবন-জীবিকা নির্বাহে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে অভিবাসিত হয়েছে। জীবিকার সন্ধানে এই অভিযাত্রা কখনো বৈধ পথে, আবার কখনো চলেছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ পথে। দুনিয়ার সকল গরিব দেশের প্রান্তিক সমাজের মানুষ একটু উন্নত জীবনের আশায়, হতাশাগ্রস্ত জীবন থেকে পরিত্রাণ ও পরিবারের হাল ধরতে সহায় সম্বল বিক্রি করে সবটুকু অর্থ মানব পাচারকারী দালাল চক্রের হাতে তুলে দেয়। কেউ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে, কারও বা সলিল সমাধি ঘটে অথৈ সাগরের নোনা জলে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর শত শত তরুণ জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢুকছে। দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইদানীং আদম পাচারে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য বেড়েছে বহুগুণ। উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রামের সহজ সরল তরুণ ও যুবকদের প্রতারণার এই ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। চলতি বছর ২৪ জানুয়ারি লিবিয়া উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালির উদ্দেশে রওনা দেয় একটি নৌকা, নৌকা ডুবে যায় যাত্রাপথে। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী আল-আকিলা থেকে ২৩ জনের গলিত লাশ উদ্ধার হয়েছে, যাদের সবাই বাংলাদেশের নাগরিক বলে লিবিয়ার রেড ক্রিসেন্ট কর্তৃপক্ষের ধারণা। এই হতভাগাদের মধ্যে মাদারীপুরের ১০ জন তরুণ রয়েছে, যা খুবই বেদনাদায়ক। ভূমধ্যসাগর মৃত্যুকূপ জেনেও ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে মানবপাচার করা হচ্ছে। প্রতিবছরই লাশ হয়ে ফিরছে পাচারকৃতরা। কারও লাশ দেখতেও পায় না স্বজনরা।
বাংলাদেশ থেকে ১৮টি রুট দিয়ে মানবপাচার করা হয় ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য সূত্রে, গত সাত বছরে ভূমধ্যসাগর দিয়ে পাচার হয়েছে সাড়ে ২০ লাখ মানুষ। এ সময়ে নৌকা ডুবে ১৯ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। কেবল ২০২৩ সালে ভূমধ্যসাগরে প্রায় দুই হাজার অভিবাসন প্রত্যাশী মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন। সমুদ্রপথে ইউরোপ যাত্রার এই ধারার শীর্ষে রয়েছে তিউনিসিয়া, বাংলাদেশ, মিসর, সিরিয়া, ইরান, আইভরি কোস্ট, ইরাক, আফগানিস্তান এবং ইরিত্রিয়া। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুদ্ধবিগ্রহ চলমান, কিন্তু বাংলাদেশে সে অবস্থা নেই। তবু রাজনৈতিক অস্থিরতার করণে তরুণদের এই ঝুঁকিপূর্ণ বিদেশ যাত্রা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৪ থেকে ২৮ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে এই দালালচক্র। কনকনে হিমেল হাওয়ার ভূমধ্যসাগরে বৈরী আবহাওয়া এবং ধারণক্ষমতার বেশি লোক নৌকায় ওঠানোর ফলে প্রায় প্রতিমাসেই নৌকাডুবির দুঃসংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। আদম পাচারে দালালদের এই দৌরাত্ম্য মালয়েশিয়া থেকে পশ্চিমে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশী মাফিয়াচক্র শত শত কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে প্রতিবছর। প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ জীবনহানিকর এই মৃত্যু যাত্রাপথ থেকে কর্মক্ষম তরুণদের বাঁচাতে পরিবারের মা-বাবাসহ জ্যেষ্ঠ সদস্যদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন, তথ্যচিত্র প্রদর্শন, স্থানীয় পুলিশ ও জনপ্রশাসনকে প্রত্যক্ষ তদারকি করতে হবে। তবেই আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রবাসীদের শ্রমজীবনে স্বস্তি ও স্থিতি ফিরে  আসবে বলে আশা করা যায়।

×