আধুনিক সমাজে যান্ত্রিকতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার যুগে আমরা ক্রমশ নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছি। প্রতিযোগিতা, স্বার্থপরতা আর অস্থিরতা আমাদের চারপাশকে ঘিরে ফেলেছে। এই ব্যস্ত জীবনে আমরা ভুলে যাচ্ছি মানবতার দুটি মৌলিক গুণÑ সহানুভূতি ও সহনশীলতা। এই দুটি গুণই আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে শান্তি ও সম্প্রীতির বীজ বপন করতে পারে।
সহানুভূতি হলো অন্যের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনাকে নিজের ভেতর অনুভব করার ক্ষমতা। এটি কোনো দয়া বা করুণা নয়, বরং এক ধরনের উচ্চ মানবিক গুণ। যখন আমরা অন্য মানুষের অনুভূতিকে সম্মান করি, তখনই আমরা প্রকৃত অর্থে মানবিক হয়ে উঠি। সহানুভূতিশীল মানুষ শুধু অন্যের দুঃখেই কাঁদে না, বরং তাদের পাশে দাঁড়ায়, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অনেকেই আজও সমাজের মূল স্রোতে আসতে পারেন না। তাদের প্রতি সহানুভূতির বদলে অনেক সময় দেখানো হয় করুণা বা অবহেলা। আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের দিকে তাকানোর সময় আমরা তাদের দুরবস্থাকে তাদেরই দোষ হিসেবে চিহ্নিত করি। অথচ, সহানুভূতির অর্থ হলো তাদের সংগ্রামকে বুঝতে চেষ্টা করা, তাদের পাশে দাঁড়ানো।
বর্তমান সমাজে সহানুভূতির অভাব অত্যন্ত প্রকট। আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্রে দেখি, রাস্তায় দুর্ঘটনায় আহত মানুষকে সাহায্য করার বদলে অনেকে মোবাইল ফোন দিয়ে ভিডিও ধারণে ব্যস্ত। এই উদাসীনতা আমাদের মানবিকতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে। তখন মনে প্রশ্ন জাগে, সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমাদের গৌরব কোথায়? কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের মধ্যেকার মনুষ্যত্ব। সহানুভূতি শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কেই নয়, সামাজিক ও বৈশ্বিক পরিসরেও জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, দারিদ্র্যÑ এই বৈশ্বিক সংকটগুলোর সমাধানও সহানুভূতির মাধ্যমেই সম্ভব।
সহনশীলতা হলো ভিন্ন মত, পথ ও বিশ্বাসকে মর্যাদা দেওয়ার ক্ষমতা। এটি কোনো দুর্বলতা নয়, বরং এক ধরনের মানসিক শক্তি। আমাদের সমাজে নানা ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে। এই বৈচিত্র্যকে সঠিকভাবে মেনে নেওয়ার মাধ্যমেই আমরা একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে পারি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজকাল আমরা সহনশীলতা হারিয়ে ফেলেছি। সামান্য মতপার্থক্যেই আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ি, সম্পর্কে ফাটল ধরে, এমনকি হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এই অসহিষ্ণুতা আরও প্রকট। অথচ ইতিহাস আমাদের শেখায়, যেসব সমাজে সহনশীলতা ছিল, তারাই উন্নতি ও শান্তির পথে এগিয়ে গেছে।
সহানুভূতি ও সহনশীলতা একে অপরের পরিপূরক। সহানুভূতি আমাদের অন্যের অনুভূতি বুঝতে সাহায্য করে, আর সহনশীলতা আমাদের সেই অনুভূতিকে মর্যাদা দিতে শেখায়। এই দুটি গুণই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে সুখ ও শান্তি এনে দিতে পারে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এই গুণগুলোর চর্চা বাড়ানো জরুরি। তাই আসুন, আমরা নিজেদের মধ্যে এই গুণগুলোর চর্চা করি এবং অন্যদেরও উৎসাহিত করি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে