ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ

সিডনির বইমেলা

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ২০:০৩, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ২০:০৩, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সিডনির বইমেলা

সিডনির মেলব্যাগ

যখন সিডনি আসি তখন বাংলাভাষী মানুষ বিশেষত বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। এক সময় যে আমাদের এক বা একাধিক বইমেলার প্রয়োজন পড়বে, সেটা দূরদর্শী ব্যতীত কারও মাথায় আসেনি। কিন্তু বাংলা বাঙালি মানেই বিদ্রোহ আর দ্রোহের ভেতর দিয়ে নতুন কোনো ইতিহাস রচনা। সে ইতিহাস কেবল যে দেশের মাটিতে রচিত হবে, এমন নয়। বরং বলা উচিত দেশের মাটি আমাদের বীজতলা। সেখানে যে চারাগাছ বা বীজের রোপণ করা হবে, কালক্রমে সেটাই মহিরুহ হয়ে দূর আকাশে সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তে পাখা মেলে। এর বড় প্রমাণ বহুজাতিক সিডনি সমাজে আমাদের আজকের অবস্থান।
যে কথা বলছিলাম, বাঙালি যখন থেকে দেশের বাইরে পা রাখে তখন থেকে তার সঙ্গে দুটি বিষয় দেশান্তরী হয়ে যায়। একটি তার ধর্ম। অন্যটি তার ইতিহাস ও সংস্কৃতি। সে সংস্কৃতির অনিবার্য নাম আমাদের ভাষা। মনে রাখতে হবে, আমরা সেই জাতি যারা রক্ত দিয়ে ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছি। সে ভাষাকে আন্তর্জাতিক বলয়ে প্রতিষ্ঠা দিয়েছি। প্রতিষ্ঠা দেওয়ার কাজটি সহজ নয়। এজন্য বাংলাদেশের বাইরে বসবাসরত বাঙালির সংগ্রাম করতে হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের যুগ যুগ পর কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীরা আমাদের যে উপহার দিয়েছেন তা আজ অহংকার। এর আগে ইংল্যান্ডসহ নানা দেশে শহীদ মিনার এবং ভাষা সৌধ নির্মিত হয়েছিল। সব মিলিয়ে আমাদের মাতৃভাষার অহংকার আজ বিশ্বজনীন। কোথায় অবস্থান করছে আমাদের এই ভাষা! বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত ভাষাগুলোর মাঝে বাংলা সপ্তম। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাংলাভাষী মানুষ বসবাস করে বাংলাদেশে, এরপর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে। এথনোলগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান পৃথিবীতে বাংলাভাষীর সংখ্যা ২৭ কোটির বেশি।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগের আগে থেকেই ভাষা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার নির্দেশ দেয়। পাকিস্তান সরকারের এমন ঘোষণার বিরোধিতা করে বর্তমান বাংলাদেশের জনগণ। তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশে এই নিয়ে আন্দোলন চলতে থাকে। সেটি সংঘাতে রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। সেই মিছিল যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি যায়, তখন পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। সেই গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ অনেকে শহীদ হন। ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর কারণে সেদিন সারাদেশে বিদ্রোহ শুরু হয়। ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর বাংলাকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হয়। সবশেষে, বাংলাভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলন এবং ভাষার অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
এখন এর ধারাবাহিকতায় আমাদের করণীয় কি? মনে করি, দেশের বাইরের বাঙালির দায়িত্ব ঘরে বাইরে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। একটা বিষয় বলা উচিত, যে প্রজন্মকে আমরা বাংলাভাষা জানে না বা বলতে লিখতে পারে না মনে করি, তারা কিন্তু শিখিয়ে দিলে বা ধরিয়ে দিলেই তরতর করে এগিয়ে যায়। সে উদাহরণ চোখে পড়বেই। কাজেই তাদের আরও বেশি বেশি যুক্ত করার দরকার আছে। এমন না যে তাদের কেবল বাংলা পড়তে বা লিখতে জানতে হবে। আন্তর্জাতিক যে কোনো ভাষাতেই তারা বাংলা ও বাঙালির ভাষার গৌরব জানতে পারে এবং তা প্রচার করতে পারে। সে দিকটাতে নজর দেওয়া জরুরি।
বলছিলাম সিডনির কথা। এখানে এখন হাজার হাজার বাঙালির বসবাস। ইংরেজিতে যাকে বলে ভাইব্রেন্ট, তেমনি এক স্পন্দনমুখর সমাজ আমাদের। বছরে সব মাসেই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য মানুষের আনাগোনা আর কর্মকাণ্ড লেগেই আছে। এগুলোর ব্যবহারিক মূল্য এবং প্রভাব আছে। কিন্তু আত্মাকে শুদ্ধ, বিবেককে জাগ্রত করে বা চিন্তাকে উসকে দিতে পারে এমন কাজ কম। এমন কাজের জন্য যে হাতিয়ার অমোঘ ও অব্যর্থ তার নাম পুস্তক। জ্ঞানের বাহন এই বই মানেই আমাদের অগ্রযাত্রার সূচনা। বাঙালি বই পড়ে, পড়তে ভালোবাসে। ডিজিটাল জগতে তার মনের বেশির ভাগ টিভি, ইউটিউব বা ফেসবুক কেড়ে নিলেও ঘুরে ফিরে পুস্তকই তার শেষ আশ্রয়। আপনি যদি ভালোভাবে চিন্তা করে দেখেন, বুঝবেন মাদার বা মা হচ্ছে লেখালেখি। একটি নাটক লিখা হলে তারপর তার শূটিং হয়। একটি গান লেখা হয়ে গেলে সুর আর কণ্ঠ যোগ হয়। অর্থাৎ লেখা বা বইপত্রই আমাদের মূল সূত্র। দেশ-বিদেশে লাইব্রেরি কিংবা বাজারে গিয়ে বইয়ের দোকান থেকে বই কেনা বা পড়ার পাশাপাশি আরও একটা বিষয় চলমান। এই জনপ্রিয় বিষয়টির নাম বইমেলা।
এতদিন ধরে আমাদের সে তৃষ্ণা মিটিয়ে এসেছে একটি বইমেলা। দীর্ঘ সময় ধরে চলমান সেই মেলাটি ইতিহাস। কিন্তু যে হারে বাঙালি বাড়ছে তাতে আরও বইমেলা হবে বা হতে পারেÑ এটাই স্বাভাবিক। এই যৌক্তিক ধারণাটি এবার সত্য করতে চলেছে আরেকটি বইমেলা। ক্যাম্বেলটাউন বইমেলা কেমন হবে, কতটা আশা পূরণ করতে পারবে বা এর চলমানতা কত দিনেরÑ সেসব প্রশ্নের উত্তর দেবে সময়। আমি বলব, এই যাত্রা আমাদের আরেকটি মাইলফলক। অঞ্চলভিত্তিক বাঙালি জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশ এই এলাকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাদের জন্য বা সবার জন্য আরও একটি বইমেলা প্রয়োজন ছিল, যা সময়ের হাত ধরে আজ বাস্তব হতে চলেছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের বায়ান্ন আর ভাষা আন্দোলন এক সূত্রে গাঁথা। এর কোনো ব্যতিক্রম বা অন্যথা হতে পারে না। আমরা মনে করি, জাতীয় আদর্শ ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি বহুজাতীয়তাকে ধারণ করে এগিয়ে চললে এই বইমেলা নতুন কোনো পালক গুঁজতে পারে বাঙালির মুকুটে। বইপ্রেমী বাঙালির এই মেলা সবার সংযোগে জয়ী হবে, এটাই প্রত্যাশা করি।
[email protected]

×