ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

ঋণের টাকার বেশিরভাগই আত্মসাৎ

ড. এস এম জাহাঙ্গীর

প্রকাশিত: ১৯:৫৮, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঋণের টাকার বেশিরভাগই আত্মসাৎ

বাজেট হলো সরকারি অর্থব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। বাজেটে যেমন সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন ঘটে তেমনি দেশের অর্থনীতির চিত্র ফুটে ওঠে। বাজেটে শুধু সরকারি সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাবই থাকে না; বরং আয়-ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেমন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে কীভাবে ঘাটতি পূরণ হবে এবং ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হলে সে উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে কী করা হবে ইত্যাদি বিষয়ও বাজেটে লিপিবদ্ধ থাকে। কোনো আর্থিক বছরে সরকারের প্রত্যাশিত আয় অপেক্ষা ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হলে তাকে ঘাটতি বাজেট বলে। বাজেটের এ ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে সরকার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঋণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান নিয়ে থাকে। এটি মূলত বৈদেশিক ঋণ। সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে সহজশর্তে ঋণ নেয়। একটি বাজেটের দুটি অংশ থাকে। একটি অংশ হচ্ছে রাজস্ব বাজেট এবং অপরটি হচ্ছে উন্নয়ন বাজেট। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য প্রতিবছর যে ব্যয় ধরা হয় এবং সরকার বিভিন্ন ধরনের কর থেকে যে টাকা আদায় করে সেটিকে বলা হয় রাজস্ব বাজেট। এ ছাড়া অবকাঠামোসহ নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য যে ব্যয় ধরা হয় সেটিকে উন্নয়ন বাজেট বলা হয়।
বাংলাদেশে বাজেট ঘাটতি পূরণ সাধারণত দুইভাবে করা হয়। একটি হলো বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে, আরেকটি হলো অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে। সরকার বিভিন্ন বৈদেশিক দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে সহজশর্তে ঋণ নেয়। এ উৎস থেকে বেশি ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে পারলে তা অর্থনীতির জন্য বেশি সহনীয়। কারণ এতে সুদহার কম এবং পরিশোধ করতে অনেক সময় পাওয়া যায়। যদিও শর্ত থাকে বেশি। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকার দুভাবে দেশের ঋণ নেয়। যেমন ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা। ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয় সরকার। তবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থ বরাদ্দ কম থেকে যায়। এতে বিনিয়োগ কমে যায়। আর ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিলে বেশি হারে সুদ দিতে হয়। এছাড়া সরকার বেশি পরিমাণ ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতিও বাড়তে পারে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে গত দেড় দশকে সরকারের অস্বাভাবিক ঋণ বৃদ্ধির এ চিত্র উঠে এসেছে। ঘোষিত বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় মেটানো ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে এ ঋণ নেওয়া হয়েছে। এ সময়ে অবাধ লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। জনগণের লুণ্ঠিত এসব অর্থ পাচার হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য বিশ্লেষণে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, বিগত সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রতিডলারে ১১৮ টাকা ধরে)।
অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সরকারের মোট ঋণ ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে তা ৭ লাখ ১৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে জনগণের কাছ থেকে এ ঋণ নিয়েছে সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিবছরই বিপুল অঙ্কের ঘাটতি রেখে বাজেট ঘোষণা করেছে। চলতি অর্থবছরেও ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি দেখানো হয়েছে, যা মোট বাজেটের ৩৬ শতাংশ। রেকর্ড এ বাজেট ঘাটতি পূরণ করতেই দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরেও সরকার দেশের ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে এ পরিমাণ ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা নেই দেশের ব্যাংক খাতের। তাই ব্যাংকগুলোর কাছে ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রি না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই এ ঋণের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। গত পাঁচ বছরে এ ঋণ বেড়েছে ৯২৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সাল শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারকে দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে তা ১ লাখ ২১ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ হিসাবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ৯২৭ শতাংশ বেড়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ২০১৭ সালে সরকারের নেওয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৭০ হাজার ৭ কোটি টাকা। গত বছর শেষে এ ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৮০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। সে হিসাবে পাঁচ বছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১৫৮ শতাংশ। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ অন্যান্য খাত থেকে এ সময়ে নেওয়া ঋণ বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। ২০১৭ সালের নভেম্বরে এ উৎসগুলো থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। গত বছরের নভেম্বরে জনগণের কাছ থেকে সরাসরি নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ১৪ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাবদ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা।
রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতার কারণে সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতায় ঘাটতি বাজেটের আকার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এটার আকার যত বড় হবে সরকারের ঋণও তত বাড়বে। মুদ্রাবাজারে তারল্য সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই এখন সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। এর মানে হলো সম্পদ সৃষ্টি না হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছাপাচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে দেশের মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখিতা থামবে না। আবার অর্থনীতির ভিতও নাজুক পরিস্থিতিতে পড়বে।
শ্বেতপত্র কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের লুটপাটতন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসাবে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুণ্ঠিত হয়ে পাচার হয়েছে বিদেশে। সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, ভৌত অবকাঠামো এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাত। শ্বেতপত্রে খাতওয়ারি লুণ্ঠনের তথ্য-উপাত্ত থেকে লুণ্ঠিত অর্থের প্রাক্কলন প্রকাশ করা হয়েছে। শ্বেতপত্রে মোট ২৮টি দুর্নীতির পদ্ধতির মাধ্যমে লুণ্ঠন প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণে নিয়ে আসা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত ও কয়েকটি ‘ট্যাক্স হেভেন’ সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচারের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। লুটেরা রাজনীতিবিদদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় অলিগার্ক ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের খেলোয়াড়, দুর্নীতিবাজ আমলা, ঠিকাদার ও মধ্যস্বত্বভোগী, হাসিনার আত্মীয়স্বজন এবং ‘ইনফ্লুয়েন্স প্যাডলার’ ও ‘হুইলার-ডিলাররা’ এই লুটপাটতন্ত্রের প্রধান চরিত্র।
লুটেরারা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে দেশের নির্বাহী বিভাগ, সিভিল প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান, সরকারি রাজস্ব আহরণ বিভাগ ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণকারী বিভাগগুলোকে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফায়দা হাসিলের অংশীদার করে ফেলেছে। দেশের বিনিয়োগ ও রাজস্ব আহরণকে তারা দুর্বল করে ফেলেছে। ধস  নামিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনকে তছনছ করে দিয়েছে। ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে অভ্যন্তরীণ খাতকে অস্থিতিশীল করে দিয়ে গেছে। বাজেট ঘাটতির দেশী-বিদেশী ঋণের ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার সিংহভাগই আত্মসাৎ করা হয়েছে।


লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

×