একটি জাতির পরিচয়ের প্রধান ভিত্তি তার ভাষাÑ এই কথাটি ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে। ভাষা শুধু ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার অধিকারের লড়াই ছিল না, এটি ছিল বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার বীজবপন। এ আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি প্রথমবারের মতো নিজেদের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল ভাষা দিবস নয়, এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি।
জাতীয়তাবাদ বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্বকীয়তা, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র গঠনের ধারণাকে বোঝায়। ভাষা জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভাষার ভিত্তিতেই জাতি গঠনের নজির পাওয়া যায়। যেমনÑ ফরাসি বিপ্লবের পর ফরাসি ভাষা পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, ১৮৭১ সালে জার্মানির একীকরণ ভাষাগত ঐক্যের কারণেই সম্ভব হয়েছিল।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলা ভাষার ভিত্তিতেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। একটি জাতির ভাষা তার ইতিহাস ও সংস্কৃতির বাহক। ভাষার মাধ্যমেই জাতি তার অতীতকে ধারণ করে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করে এবং জাতিগত ঐক্য বজায় রাখে। এক ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠীর মাঝে পারস্পরিক সংযোগ সৃষ্টি হয়, যা জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম দেয়। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন প্রমাণ করেছে, যখন একটি জাতির ভাষার ওপর আঘাত আসে, তখন তা শুধু ভাষার বিষয় থাকে না; বরং তা হয়ে ওঠে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চায়, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ৫৬ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলত। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’Ñ এটি ছিল বাঙালি জাতিসত্তার ওপর প্রথম বড় আঘাত। ভাষার জন্য প্রথম প্রতিবাদ হয় তখনই। এরপর ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। সময়ের ক্রমান্বয়ে আন্দোলন বাড়তে থাকে। নানা ঘটনা পেরিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার শহীদ হন। এই আত্মত্যাগের ফলে ১৯৫৬ সালে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ তথা জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। ভাষা আন্দোলন বাঙালির মনে জাতিগত স্বকীয়তার চেতনা জাগিয়ে তোলে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানÑ এসব আন্দোলনের শেকড় ছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির প্রধান পরিচয় ছিল তার ভাষা ও সংস্কৃতি। পাকিস্তানি শাসকরা ধর্মের ভিত্তিতে এক রাষ্ট্র গঠন করতে চাইলেও বাঙালিরা তাদের ভাষার ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জন করে। তাই বলা যায়, ‘যদি ১৯৫২ না হতো, তবে ১৯৭১ আসত না।’
ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষার অধিকারের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। প্রতি বছর এই দিনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়, যা ভাষার প্রতি মানুষের আবেগ ও অধিকারের স্বীকৃতি বহন করে। আজকের বিশ্বায়নের যুগে অনেক জাতিই তাদের মাতৃভাষার ওপর যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না। ভাষার অবহেলা মানেই জাতির শেকড় দুর্বল হয়ে যাওয়া। তাই ভাষা দিবস কেবলমাত্র অতীতের গৌরবগাথা নয়, এটি ভবিষ্যতের পথনির্দেশকও। তাই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা, বাংলা ভাষার শুদ্ধ চর্চা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো, তরুণ প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস শেখানো আমাদের দায়িত্ব।
সুতরাং ভাষা দিবস কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, এটি আমাদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদরা আমাদের শিখিয়ে গেছেন, ভাষার মর্যাদা রক্ষা মানেই জাতির মর্যাদা রক্ষা। তাই বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, এর সঠিক চর্চা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর গুরুত্ব তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। যাতে একই সুরে বলতে পারি ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা!’
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ