শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড, আর গবেষণা সেই শিক্ষার প্রাণশক্তি। জ্ঞানার্জনের প্রকৃত অর্থ কেবল বই পড়া নয়, বরং শেখা, বিশ্লেষণ করা ও নতুন কিছু উদ্ভাবন করা। গবেষণার মাধ্যমেই নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয়, যা ব্যক্তি, সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞানভিত্তিক সমাজে টিকে থাকতে এবং উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে গবেষণায় শিক্ষার্থীদের আত্মনিয়োগের বিকল্প নেই। গবেষণা শিক্ষার্থীদের এমন এক দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করে, যা তাদের শুধু ভালো পেশাজীবী নয়, বরং একজন উদ্ভাবক, নেতা ও সমস্যার সমাধানকারী হিসেবে গড়ে তোলে। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হলো গবেষণা ও উদ্ভাবন। কোনো দেশ যদি টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণা নতুন প্রযুক্তি, শিল্প খাতের উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং এর মাধ্যমেই শিল্প বিপ্লব, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। একটি দেশের নিজস্ব গবেষণা না থাকলে প্রযুক্তি ও জ্ঞানগতভাবে সে দেশ অন্যদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে বিদেশী প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়ে, যা অর্থনৈতিকভাবে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে গবেষণার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। তবে গবেষণার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানবকল্যাণ। করোনা ভাইরাস মহামারির সময় গবেষণার গুরুত্ব আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। বিশ্বজুড়ে গবেষণার মাধ্যমেই ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে, যা লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে চিকিৎসা গবেষণার বেহাল দশার কারণে দেশকে বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। কৃষি গবেষণা ও খাদ্য নিরাপত্তা দিকে তাকালে দেখা যায় একসময় বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির ছিল। কিন্তু কৃষি গবেষণার মাধ্যমে উন্নত জাতের ফসল উদ্ভাবন করায় বর্তমানে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছি। যদিও কৃষি গবেষণায় আরও বিনিয়োগ দরকার, যাতে জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ফসল উদ্ভাবন করা যায়। এতে দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে। গবেষণা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
একটি দেশের অর্থনীতি তখনই শক্তিশালী হয় যখন তার উৎপাদন খাত দক্ষ ও উন্নত হয়। গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির উপায় বের করা সম্ভব হয়, যা কম খরচে বেশি পণ্য ও সেবা উৎপাদনে সহায়তা করে। গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কর্মসংস্থানের জন্য আরও বেশি যোগ্য হয়ে ওঠে। একজন গবেষণা-ভিত্তিক শিক্ষার্থী কেবল চাকরির জন্য অপেক্ষা করবে না, বরং নিজেই নতুন উদ্যোগ নিতে পারবে। এতে দেশে যেমন বেকারত্বের হার কমবে, তেমনি নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া গবেষণা নিজেই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। উন্নত বিশ্বে গবেষণামূলক কাজের মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি, চিকিৎসা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং খাত গড়ে উঠেছে। যা ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। গবেষণা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও পথপ্রদর্শক। গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পণ্য উদ্ভাবিত হলে তা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হয়। গবেষণায় বিনিয়োগ করলে দেশীয় পণ্য ও সেবার গুণগত মান বাড়ে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয় পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলাও গবেষণার ভূমিকা অনস্বীকার্য। গবেষণা একটি দেশের সমাজ, অর্থনীতি, মানবকল্যাণ, পরিবেশ, জলবায়ু সবকিছুর জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার অবস্থা সন্তোষজনক নয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশের গবেষকরা মাত্র ১১,৪৭৭টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। যেখানে ভারতের গবেষকরা ২,২২,৮৪৯টি এবং পাকিস্তানের গবেষকরা ৩৫,৬৬৩টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। এই পরিসংখ্যান আমাদের গবেষণা কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট করে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মোট গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে মৌলিক গবেষণায় খরচ হয়েছে মাত্র ৯৪১.৫৪ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৮.৯৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে পরীক্ষামূলক উন্নয়নে, যা মোট ব্যয়ের ৫২.৭ শতাংশ। ফলিত গবেষণায় ব্যয় হয়েছে ৩৭.৪০ শতাংশ।
ইউনেস্কোর মতে, কোনো দেশের বাজেটের ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬ শতাংশ গবেষণা খাতে বরাদ্দ করা উচিত। বাংলাদেশে এই হার জিডিপির ২ শতাংশেরও নিচে, যা গবেষণার অপ্রতুলতার একটি প্রধান কারণ। যেখানে জাপানে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য জিডিপির ৩.৪ শতাংশ ব্যয় করে, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪.৮ শতাংশ, চীনে ২.২ শতাংশ ব্যয় করে। সেখানে বাংলাদেশ গবেষণায় মাত্র ০.৩ শতাংশ বাজেট ব্যয় করে। যা সত্যি হতাশাজনক। তরুণরা হলো ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের বাহক। কিন্তু শুধু সাধারণ পড়াশোনার মাধ্যমে তারা বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। তার জন্য প্রয়োজন বাস্তবসম্মত গবেষণার জ্ঞান। তাই দেশের স্বার্থে গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। গবেষণার জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষা খাতে বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গবেষণার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক গবেষণাগার ও পর্যাপ্ত উন্নত মানের সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। গবেষকদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশিক্ষকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাইমারি লেবেল থেকে শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করতে হবে। যাতে ছোট থেকে গবেষণার প্রতি শিক্ষার্থীদের ভালোলাগা তৈরি হয় এবং ক্রমেই জানার আগ্রহের বিস্তার ঘটে। গবেষণার জন্য উপযুক্ত নীতিমালা ও প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। বিদেশী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণা কার্যক্রম ও ফেলোশিপের সুযোগ বাড়াতে হবে। এতে দেশীয় শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। শুধু সনদভিত্তিক শিক্ষার চেয়ে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলেই একটি জাতিকে জ্ঞান-সমৃদ্ধ করা সম্ভব। দেশের স্বার্থে, তরুণদের এগিয়ে নিতে এবং সার্বিক উন্নতির জন্য গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি। তাই সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে গবেষণার বিকাশে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে এবং বাংলাদেশ একটি গবেষণাবান্ধব উন্নত দেশে পরিণত হয়।
শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ