ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২ মাঘ ১৪৩১

গুগলে বাংলা ভাষা

ড. এম. মেসবাহ উদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

গুগলে বাংলা ভাষা

বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগল

বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগল। এর জনপ্রিয় একটি ওয়েব ব্রাউজার হচ্ছে গুগল ক্রোম। প্রতিদিন সারাবিশ্বের কয়েকশ’ কোটি মানুষ অনলাইনে নিজেদের যাবতীয় কাজের জন্য গুগল ক্রোম ব্যবহার করেন। তবে এই বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে এমন কেহ আছেন যারা ইংরেজি ভাষায় খুব একটা দক্ষ নন। তাদের জন্য গুগল বিভিন্ন ভাষায় গুগল ক্রোম ব্যবহারের সুবিধা এনেছে।

বাংলা থেকে শুরু করে বিশ্বের আরও বেশকিছু ভাষার সাপোর্ট রয়েছে গুগল ক্রোমে। কম্পিউটার, স্মার্টফোনসহ অন্য সব ডিভাইসে গুগল ক্রমের সাহায্যে সেসব আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা যায়। গুগলে এ ধরনের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে গুগল বোর্ড, যেখানে জনপ্রিয় শতাধিক ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষাও সংযুক্ত আছে। এটি চ্যাট জিপিটির মতোই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সম্পন্ন একটি কথোপকথনমূলক চ্যাটবট। বর্তমানে এটি জেমিনি (এবসরহর) নামে পরিচিত।

একটি বৃহৎ ভাষা মডেল ‘ল্যামডা’ পরিবারের ওপর ভিত্তি করে এটি তৈরি করা হয়েছে, যা ইংরেজি এবং বাংলাসহ অনেক ভাষায় কাজ করতে পারে। বাংলা ভাষায় ‘বার্ড’ এর চালু করা বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের জন্য একটি বড় সুবিধা। চ্যাটজিপিটির আদলে তৈরি ‘বার্ড’ হলো গুগলের একটি তথ্যপূর্ণ এবং ব্যাপক ভাষা মডেল যা পাঠ্য তৈরি করতে, ভাষা অনুবাদ করতে, বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল সামগ্রী লিখতে এবং প্রশ্নের উত্তর তথ্যপূর্ণ উপায়ে দিতে পারে।

বাংলা ভাষাভাষীরা এখন বার্ডের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় পাঠ্য তৈরি করা, বাংলা ভাষা থেকে অন্য ভাষাতে এবং অন্য ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা, বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল সামগ্রী লিখা, যেমন কবিতা, গল্প, কোড, স্ক্রিপ্ট, ই-মেইল, চিঠি ইত্যাদি করতে পারেন।
আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্ট হিসেবে বাংলা ভাষায় গুগল বার্ড চালু করা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় পদক্ষেপ। এটি বাংলাদেশের মানুষকে তথ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও বেশি সুবিধা প্রদান করছে এবং ফলে তারা বিশ্বের অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশ্বের অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবসা-বাণিজ্যে লাভবান হতে পারবে।

এক্ষেত্রে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা গুগল সার্চের মাধ্যমেও বার্ড অ্যাক্সেস করতে পারেন ব্যবহারকারীরা। তবে এর ফলে ব্যাপক পরিবর্তনের আশঙ্কাও রয়েছে। কারণ এটি একটি শক্তিশালী সরঞ্জাম হলেও এর কিছু দুর্বল দিক রয়েছে। যেমন :
১. তথ্য ত্রুটি : বার্ড একটি বড় ভাষা মডেল এবং এটি প্রচুর পরিমাণে তথ্য প্রক্রিয়া করে। কিন্তু বার্ড তথ্য ভা-ারে বাংলা শব্দের পরিপূর্ণতা এখনো সমাপ্ত হয়নি ষ ফলে এটি ত্রুটি হতে পারে। বার্ড থেকে তথ্য ব্যবহার করার সময় সতর্ক থাকা গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যান্য উৎস দিয়ে তা যাচাই করা উচিত। কারণ কোনো ভুল তথ্য শেয়ার করার কারণে সমাজে অনেক বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।
২. সৃজনশীলতা : বার্ড একটি ভাষা মডেল বটে, সৃজনশীল নয়। বার্ড নতুন ধারণা তৈরি করতে পারে না, তবে এটি বিদ্যমান ধারণাগুলো নতুন ভাবে প্রকাশ করতে পারে। তবে গুগল বার্ড রিয়েল-টাইম, ফ্যাক্ট-চেকড রেসপন্স এবং ইকোসিস্টেম ইন্টিগ্রেশনের ওপর জোর দেয়।
এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় রূপান্তরের জন্য বেশ জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম গুগল ট্রান্সলেট। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহারের মাধ্যমে সম্প্রতি প্ল্যাটফর্মটিতে আরও ১১০টি নতুন ভাষা যুক্ত করছে গুগল। এর মধ্যে ক্যান্টোনিজ, পাঞ্জাবি ও মাড়ওয়ারি উল্লেখযোগ্য। গুগলের তথ্যানুযায়ী, নতুন যুক্ত মোট ভাষার এক-তৃতীয়াংশ এসেছে আফ্রিকা থেকে। এসব ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৬১ কোটি ৪০ লাখের বেশি।

নতুন ভাষা যুক্ত করার জন্য নিজেদের লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেল ‘পিএএলএম ২’ ব্যবহার করেছে টেক জায়ান্টটি। গুগল ট্রান্সলেটে এর আগে কখনো এতগুলো ভাষা একসঙ্গে যুক্ত করা হয়নি। আগে কেবল ১৩৩টি ভাষা অনুবাদ করতে পারত গুগল ট্রান্সলেট। নতুন আপডেটের পর মোট ২৪৩টি ভাষায় অনুবাদ করতে পাচ্ছে এখন প্ল্যাটফর্মটি।

যে কোনো ব্রাউজার থেকে গুগল ট্রান্সলেটের ওয়েবসাইটে গিয়ে এসব ভাষায় অনুবাদ করা যায়। অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএস ডিভাইসের অ্যাপ থেকেও এসব ভাষা অনুবাদ করা যায়। ২০২২ সালে প্ল্যাটফর্মটিতে ১ হাজার ভাষা যুক্ত করার উদ্যোগ নেয় গুগল। সবশেষ ১১০টি নতুন ভাষা যুক্ত করার বিষয়টি সেই উদ্যোগেরই অংশ।
উল্লেখ্য,  ২০১৫ সালে গুগল অনুবাদে চার লাখ বাংলা শব্দ যোগ হয়েছিল। ২০১১ সালে ৬৫তম ভাষা হিসেবে প্রযুক্তি জায়ান্ট গুগলের এই সেবায় বাংলা যুক্ত হয়। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে গুগল তাদের ট্রান্সলেটর অ্যালগোরিদমে সম্প্রতি ৭ লাখ নতুন শব্দ যোগ করেছে যাতে অনুবাদ হওয়া বাক্য আরও অর্থপূর্ণ ও সুন্দর হয়। তবুও অনেক সময়েই ট্রান্সলেটরের বাক্য অর্থপূর্ণ হয় না।

কারণ যে ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে, সে ভাষায় শব্দভা-ার কম থাকায় এমনটি হয়  বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এখনো এমনটি ঘটে। তাই এর উন্নয়নের দিকে সর্বক্ষণিক নজর আছে গুগল টিম এবং বাংলা ভাষায় পারদর্শী তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের। 
নতুন ভাষা বেছে নেওয়ার জন্য প্রতিটি ভাষার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রূপগুলো অগ্রাধিকার দেয় গুগল। বিষয়টি স্পষ্ট করতে একটি  উদাহরণ দিয়েছে কোম্পানিটি। গুগল বলেছে, ইউরোপজুড়ে রোমানি ভাষার অনেকগুলো উপভাষা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণী ভ্লাক্স রোমানি ভাষা বেছে নিয়েছে এআই মডেলটি। কারণ এটি অনলাইনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

এ ছাড়া ভাষাগুলোর বিশালসংখ্যক টেক্সটের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে এসব ভাষা নির্বাচন করা হয়। কারণ টেক্সটের ওপর ভিত্তি করেও এআই মডেল প্রশিক্ষিত হয়। জিবুতি, ইরিত্রিয়া ও ইথিওপিয়ায় ব্যবহৃত কথ্য ভাষা ‘আফার’কেও যুক্ত করেছে গুগল। আমাদের দেশে নোয়াখালী, বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং সিলেটের ভাষার মধ্যে  বেশ স্বতন্ত্রতা আছে উপজাতীয় অনেক ভাষাও দেশে বিদ্যমান।

এসব প্রত্যেকটি ভাষার স্বকীয়তা বজায় রেখে গুগল ট্রান্সলেট এবং গুগল বার্ড এ তাদের নিজস্ব ভাষা অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান আদিবাসী মানুষের গুগলের ভয়েস টাইপিং তথা গুগল ডক্স এর সুবিধাও অনেক সময় বাঁচাতে কেহই এখন আর কিবোর্ড নিয়ে টাইপ করতে বসে না। ওপেন করে গুগল ডক্স। দ্রুত টাইপ করার জন্য এটি খুবই জনপ্রিয়।

দরকার নেই কম্পিউটারের ডেক্সটপ কিংবা ল্যাপটপের কিবোর্ড। মোবাইল থেকে দ্রুত টাইপ করতে চাইলেই হাত বাড়িয়ে দেয় গুগলের ভয়েস টাইপিং পদ্ধতি। সাধারণত মোবাইল ফোনের কিপ্যাড দিয়ে তেমন একটা দ্রুত লেখা সম্ভব হয় না। এমনকি বাংলাতে লেখার স্পিড আরও কম হয়। এজন্য গুগল ডক্সের ভয়েস টাইপিং খুবই নির্ভরযোগ্য।
ভাষা হলো মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের মাধ্যম। এটি আমাদের ভাবনা, অনুভূতি, জ্ঞান ও ধারণা প্রকাশ করার একটি উপায়। এটি আমাদের সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ করার একটি সেতু তৈরি করে। সম্পূর্ণ মানব সভ্যতা ভাষার ওপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাষার আদান-প্রদানের জন্য গুগল ছাড়াও রয়েছে নানা প্ল্যাটফর্ম। তবে একটি ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করার জন্য গুগল ট্রান্সলেটর একটি অসাধারণ প্রযুক্তি, যা চ্যাটজিপিটিকে ছাড়িয়ে গেছে বহুদূর।

কিন্তু গুগলের বার্ড, গুগল ট্রান্সলেটর কিংবা গুগল ডক্স ইত্যাদি কেহ কারো প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য বাজারে আসেনি, বরং যৌক্তিক উত্তর দিয়ে গুগল অনুসন্ধানকে সহায়তা করার জন্য তৈরি। চ্যাটজিপিটি একটি ভাষা প্রজন্মের মডেল, আর বার্ড একটি পাঠ্য সমাপ্তি মডেল। উভয়েরই নিজস্ব শক্তি এবং সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং তাদের নিজ নিজ ডোমেনে অত্যন্ত সফল।

এ ছাড়াও ভাষা ট্রান্সলেটরের জন্য জনপ্রিয় আরও কিছু প্ল্যাটফর্ম আছে প্রত্যেকটি প্ল্যাটফর্ম নির্দিষ্ট কিছু ভাষার জন্য খুবই জনপ্রিয়। যেমন গুগল ট্রান্সলেটর ফরাসি, জার্মান এবং স্প্যানিশ ভাষার জন্য ভালো। মাইক্রোসফট ট্রান্সলেটর এশিয়ান ভাষা যেমন চীনা, জাপানি এবং কোরিয়ানের জন্য চমৎকার। ডিপএল (উববঢ়খ) মাইক্রোসফট ট্রান্সলেটর ইউরোপীয় ভাষা, বিশেষ করে জার্মান, ফ্রেঞ্চ এবং স্প্যানিশের ক্ষেত্রে ভালো।

পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। এই বিপুলসংখ্যক লোকের তথ্য আদান-প্রদানে আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি বাংলা ভাষাকে আরও জনবান্ধব করবে এমনটিই প্রত্যাশা।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×