সম্প্রতি সবজির বাম্পার ফলনে মূল্য নিয়ে হতাশায় ভুগছেন কৃষক
সম্প্রতি সবজির বাম্পার ফলনে মূল্য নিয়ে হতাশায় ভুগছেন কৃষক। উৎপাদন খরচ মোটামুটি মিললেও দেখতে পাচ্ছেন না লাভের মুখ। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখলাম ভরপুর ফলনেও কাঁদছেন চাষি। প্রায় বছরেই এ রকম খবর আমাদের চোখে পড়ে। শিম নেন ১০ টাকায়। নিলে নেন দশ টাকায়, বাইছা নেন দশ টাকায়, কেজি নেন দশ টাকা।
অথবা ফুলকপির হালি বিশ। নতুন আলু নেন ২৫-এ, চার কেজি একশ’, চার কেজি একশ’; পেঁয়াজ নেন দুই কেজি নব্বই। এরকম হাঁকডাক চলতি পথের ক্রেতাকে আকৃষ্ট করে। সম্প্রতি ‘পানির দামে আলু, দিশাহারা কৃষক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ। প্রতিবেদনটির পুরো অংশ যদি কোনো পাঠক নাও পাঠ করেন, তারপরও তার পক্ষে অবস্থা কল্পনা করা কঠিন নয়। মৌসুম শুরুর আগে বাজারে আলুর দামের কথা ক্রেতা ভুলে যাননি।
খাবার জন্য ৮০ টাকা কেজি দরে আলু কিনতে হয়েছে কৃষককেও। তার হাতেও তখন আলু ছিল না। মৌসুমের শুরুতেই বাজারে চাহিদার অতিরিক্ত আলু হিমাগারে ঢুকে যায়। কম দামে সংগ্রহ করা আলুই, কয়েক মাস হিমাগারে থেকে বেরিয়ে আসে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রির জন্য। মাঠ থেকে হিমাগার হয়ে ক্রেতার হাতে আসার আগেই মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে পড়ে আলুর দাম বাড়ে কয়েকগুণ। মাঝ থেকে কৃষকের ভাঁড়ার থাকে শূন্য।
আর বাড়তি চাপে খালি হয় ভোক্তার পকেট। গত বছরের প্রায় পুরোটা সময় আলোচনায় ছিল আলুর দাম। আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে বাধ্য হয়ে পণ্যটির আমদানি শুল্ক কমিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। আমদানিও হয়েছে কিছুটা। বাজারে এর প্রভাব দেখা যায়নি, বরং দাম বেড়েছে। এখন দেশের বাজারে আলু ওঠায় দাম কমছে। এদিকে এ বছর আলুর ফলনও ভালো হয়েছে। কৃষি বিভাগ বলছে, অনুকূল আবহাওয়া থাকায় ভালো হয়েছে আলুর ফলন।
এখন খোলাবাজারে আলুর কেজি ২০-২৫ টাকা। ফলে, আলুর বাড়তি দামের আশা যারা করেছিলেন, তারা লোকসানের ঝুঁকিতে পড়েছেন। আলুর জন্য বীজ, সার, কীটনাশকসহ সবটার খরচ কিন্তু একই। প্রায় দ্বিগুণ খরচ করেও কৃষক উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না। এ দিকটিতে আমাদের নজর দেওয়া জরুরি। কৃষক যদি ক্রমাগত লোকসানের সম্মুখীন হন, তাহলে সবজি উৎপাদনে কৃষকের উৎসাহ হ্রাস পাবে। ব্যর্থ হবে সবজি বিপ্লব। উৎপাদন কমে যাবে, ব্যবহার হ্রাস পাবে এবং পুষ্টিনিরাপত্তা হবে বিঘিœত। আগামী প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশ হবে চরম হুমকির সম্মুখীন।
ফুলকপির সঙ্গে বাঁধাকপি, মুলা ও শিম, লালশাক ও লাউশাকের দামেও ধস নেমেছে। বর্তমানে প্রতিকেজি মুলা ময়মনসিংহের ত্রিশাল, ভালুকা, ফুলবাড়িয়া উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫-৬ টাকা কেজি দরে, যা এক মাস আগেও ছিল ৩০-৪০ টাকা কেজি। এ ছাড়া নভেম্বর মাসে যে বাঁধাকপি প্রতিটি বিক্রি হয়েছে ৪০-৫০ টাকা এখন সেই বাঁধকপির জোড়া বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়।
আজ থেকে এক মাস আগে যে শিম বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা কেজি দরে এখন তা বিক্রি হচ্ছে শুধু ২০ টাকা কেজিতে। যে লাউশাক আজ থেকে এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা আঁটিতে, সেই আঁটি বিক্রি হচ্ছে এখন ১০ টাকায়। আর ১০ টাকা আঁটির লালশাক বিক্রি হচ্ছে দুই আঁটি ১০ টাকায়। যে আলু ও বেগুন দুই মাস আগে প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়, সেই আলু ও বেগুন এখন বিক্রি হচ্ছে ২০-৩০ টাকা কেজি দরে।
আমাদের কথা হলো, রেল-সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে যদি সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতি পূরণ দিতে পারে, তাহলে সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য জোগাতে গিয়ে যে কৃষক ক্ষতির শিকার হন, তিনি কেন সরকারি ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হবেন।
এ ধরনের পরিস্থিতির কিছু কারণ প্রাকৃতিক, আবার কিছু মানুষ সৃষ্ট। যেমনÑ ১. সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বেশি বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষক ফুলকপির চারা তৈরি করেও সময়মতো মূল জমিতে লাগাতে পারেননি। বৃষ্টির পর জমিতে জো আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সব চাষি একযোগে জমিতে ফুলকপির চারা রোপণ করেন এবং কিছু দিন পরই ফুলকপিতে বাজার ছয়লাব হয়ে যায়। এ বছর খরিপ-১ ও খরিপ-২ মৌসুমে সবজির দাম তুলনামূলকভাবে বেশি থাকায় কৃষক বেশি লাভের আশায় রবি মৌসুমে ব্যাপকভাবে চাহিদার তুলনায় বেশি জমিতে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, লালশাক প্রভৃতি সবজির চাষ করেন।
চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলে পণ্যের মূল্য কমে যাবে- এটা অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম। এ ছাড়া আলু সংরক্ষণের জন্য দেশে অনেক হিমাগার থাকলেও ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, মুলা সংরক্ষণের জন্য কোনো বিশেষায়িত হিমাগার নেই। আবার ফুলকপি, বাঁধাকপি উত্তোলন করে আলু, পেঁয়াজ ও রসুনের মতো দেশীয় পদ্ধতিতে ঘরেও সংরক্ষণ করা যায় না। কারণ, এগুলো অত্যন্ত পচনশীল পণ্য। শুধু সংরক্ষণের অভাবে বাংলাদেশে উৎপাদিত সবজির প্রায় ৩০ ভাগ বিনষ্ট হয়ে যায়।
২. একই সময়ে বাজারে চাহিদার চেয়ে বেশি সবজির সরবরাহ, ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা, উচ্চ পরিবহন খরচ ও পথে পথে চাঁদাবাজি এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের কৃষককে ঠকিয়ে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার অসাধু প্রবণতা সবজির মূল্য পতনের অন্যতম কারণ বলে মনে হয়। ৩. অনেক কৃষিবিদ বলছেন মন্ত্রণালয়ের সঠিক নির্দেশনার অভাব, স্থানীয় পর্যায়ে বাজার ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা, নিম্নমানের বীজ, সার সরবরাহের সিন্ডিকেট, কৃষি ঋণ/প্রণোদনা প্রভাবশালীদের দখলে নেওয়া ইত্যাদিও কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়।
স্বল্প সময়ে অল্প জমি থেকে অধিক আয়, সারাবছর চাষোপযোগী উচ্চফলনশীল সবজির গুণমানের বীজ উৎপাদন, বিপণন এবং সবজি চাষের আধুনিক প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার এবং ফলন বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে ঘটে গেছে সবজি উৎপাদনে এক নীরব বিপ্লব। এ বিপ্লবের নায়ক হলেন আমাদের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ও কর্মঠ কৃষক। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় সোয়া দুই কোটি টনের মতো সবজি উৎপাদন হয়। সবজি রপ্তানি করেও বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত সবজি রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করে ১ কোটি মার্কিন ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। চলতি অর্থবছরে কৃষিপণ্য থেকে ১১২ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য খাতের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজারের আকার ছিল ১৩ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। গত বছর বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বাজার (দেশীয় চাহিদা ও রপ্তানি) ছিল ৪৮০ কোটি ডলারের।
আর কৃষিপণ্যের বাজার ছিল চার হাজার ৭৫৪ কোটি ডলারের। তবে অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে, কৃষিপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তামাক। মোট রপ্তানি আয়ের এক-তৃতীয়াংশই আসে তামাক রপ্তানি থেকে। গত ছয় মাসে এসেছে প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য খাত জিডিপিতে ২ শতাংশেরও কম অবদান রেখেছে, যা পাশের দেশের তুলনায় অনেক কম।
সবশেষে বলা যায়, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের সিংহভাগই কৃষকের সন্তান। তাহলে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রদান এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পুনর্বাসনের বিষয়টিও জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা এবং সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। আমাদের দেশে কৃষকরা অন্য দেশের মতো সংগঠিত নন।
তাদের কোনো কার্যকরী সংগঠন নেই। যেগুলো আছে সেগুলোর কাজ হলো সরকারের লেজুড়বৃত্তি করা। তাহলে কে করবে কৃষক বাঁচানোর আন্দোলন? ভারতের মতো গড়ে তুলবে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে রাজধানী কাঁপানো সংগ্রাম? কৃষক ঋণের দায়ে হাজতে গেলেও আমাদের নেতাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। নেই কৃষক বাঁচানো, কৃষি জমি সুরক্ষা, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের দাবি, পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে, ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন।
কারণ, দেশের অধিকাংশ কৃষক নেতাদের সঙ্গে কৃষি ও কৃষকের, মাটি ও ফসলের কোনো সম্পর্ক নেই। নেই কৃষকের সমস্যাসংক্রান্ত তাদের কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা ও আগ্রহ। বিদেশে প্রচুর পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত কৌটা, টিন ও বয়ামজাত সবজি পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে টমেটো সস ছাড়া আর কোনো প্রক্রিয়াজাত সবজির দেখা মেলে না। প্রক্রিয়াজাতের ফলে বেশি মূল্য সংযোজন হয় এবং কৃষকও উৎপাদিত সবজির ন্যায্যমূল্য পেতে পারেন।
কৃষককে তার উৎপাদিত সবজির ন্যায্যমূল্য প্রদান নিশ্চিত করতে হলে সংযোগ চাষির মাধ্যমে উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণ করে নিরাপদ সবজি উৎপাদন এবং বিদেশে রপ্তানি করতে হবে। দেশের অর্থনীতির মূল কাঠামো কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। তাই এ খাতে সঠিক প্রণোদনা, রপ্তানি বাড়াতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ, তাজা ফলমূল ও শাকসবজি সংরক্ষণে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি।
লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য
সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা