ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২ মাঘ ১৪৩১

বইমেলার মাসে গোথেনবার্গ বইমেলার স্মৃতি

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বইমেলার মাসে গোথেনবার্গ বইমেলার স্মৃতি

সুইডেনের গোথেনবার্গ বইমেলায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল

বছর পাঁচেক আগে সুইডেনের গোথেনবার্গ বইমেলায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এটি উত্তর ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা। প্রথম দিন রীতিমতো হোঁচট খেয়েছি। মেলা বলতে আজন্ম পরিচিত স্টল, প্যাভিলিয়নে ভিড়ে ঠাসা উন্মুক্ত চত্বরের ধারণাই গাঁথা ছিল মনে। ওখানে গিয়ে অবাক। এগারো হাজার দুশ’ একানব্বই স্কয়ার মিটার আয়তনের মেলা পুরোটাই ইনডোর। সম্ভবত এ দেশের আবহাওয়ার জন্য এমন আয়োজন।

কনকনে শীত। দিনে কয়েকবার বৃষ্টি। বৃষ্টি হলে শীতের প্রকোপ আরও বাড়ে। বেশির ভাগ সময়ই মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া। এতসব সামলে খোলা মাঠে মেলা করা বেশ কঠিনই। ছিমছাম সাজানো স্টল। দৈর্ঘ্য-েপ্রস্থে কোনোটাই খুব বেশি বড় বা ছোট নয়। একটার সঙ্গে অন্যটার সংগতি রেখে সাজানো। স্টল বা প্যাভিলিয়ন প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা নেই।

কোনোটা প্রাসাদোপম, কোনোটা দীনহীন চেহারা নিয়ে করুণা প্রার্থীর মতো দাঁড়িয়ে নেই। পুরো মেলা একটি ছন্দোবদ্ধ ঐক্যে সাজানো। ক্রেতা-দর্শক আছে প্রচুর, তবে ঠেলাঠেলি বা উপচেপড়া ভিড় নেই। মেলা আয়োজকদের পরিসংখ্যান মতে, সেবার ভিজিটর এসেছিলেন ছিয়াশি হাজার একশ’ বত্রিশ জন।
অমর একুশে গ্রন্থমেলার মতো ওখানেও ক্রেতার চেয়ে দর্শক বেশি। তবে আমজনতার হইচই নেই। এর কারণ বুঝতে দেরি হয় না। এ মেলায় ইচ্ছে হলেই কেউ ঢুকতে পারে না। আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন করা থাকলে তবেই দ্বার উন্মোচিত, নইলে নয়। আমাদের একুশে বইমেলা নিয়ে উপচেপড়া আবেগের আড়ালে চাপা পড়ে থাকে অনেক কিছু। ভাষা আন্দোলনের পর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার এবং বাংলাকে বিকশিত করার পরিসর তৈরির কথা ছিল।

কথা ছিল বাংলা হবে আন্তর্জাতিকমানের যে কোনো ভাষার সমতুল্য। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের এত বছর পর বাংলার ভবিষ্যৎ ভাবলে সত্যিই শিউরে উঠতে হয়। এত সমৃদ্ধ একটি ভাষা উত্তর ঔপনিবেশিক রাজনীতি ও অর্থনীতির খপ্পরে পড়ে দিন দিন বদ্ধ ডোবায় পরিণত হচ্ছে। শিল্পোন্নত দেশগুলো পুঁজির জোরে ভাষার ওপরও আধিপত্য করে যাচ্ছে। 
গোথেনবার্গ বইমেলার যে বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি কেড়েছে তা হলো সেমিনার। মেলার মধ্যেই জায়গায় জায়গায় ছোট ও বড় পরিসরে সেমিনার চলছে। স্টলের ভেতরেই অপেক্ষাকৃত বড় স্টেজে চার-পাঁচজন আলোচক গোল হয়ে বসে আছেন, উপস্থাপক একজন একজন করে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলছেন। দর্শক সারিতে মনোযোগী দর্শকশ্রোতা তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আলোচনা শুনছে।

আবার ছোট স্টলে দুজন বসতে পারে এরকম ছোট স্টেজেও একজন আলোচক ও উপস্থাপক কথা বলছেন, দর্শকরা দাঁড়িয়ে শুনছে। কোথাও স্টেজ ছাড়াই মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে আলোচকের সঙ্গে কথা বলছেন উপস্থাপক, দর্শকরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা শুনছেন। আশ্চর্য লাগে পায়ে পায়ে এরকম আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে অথচ কোথাও কোনো উচ্চকিত শব্দ নেই। কতটুকু শব্দ হলে পাশের স্টলের আলোচক কিংবা ক্রেতা দর্শকের শ্রুতি উৎকট শব্দে আক্রান্ত হবে না তার যথাযথ পরিমাপ ওরা করে নিয়েছে। মাইক্রোফোন যে চলছে তা ওই নির্দিষ্ট জায়গায় না গেলে বোঝা যায় না।
মেলায় সেমিনার হয়েছে তিনশ’ চব্বিশটি। আটশ’ ত্রিশটি দেশের অংশগ্রহণে মোট প্রোগ্রাম হয়েছে চার হাজার একশ’ পঁচাশিটি। ভাবা যায়, ২৬-২৯ সেপ্টেম্বর, চার দিনের বইমেলায় এত প্রোগ্রাম! আসলে এগুলোই এ মেলার প্রাণ। বইমেলাকে কেন্দ্র করে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর জমজমাট সাহিত্য উৎসব হয় এখানে। উত্তর ইউরোপের সবচেয়ে বড় সাহিত্য উৎসব এটি। আর ফ্রাঙ্কফুর্টের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা। গথিয়া টাওয়ারের নিচে অনুষ্ঠিত উৎসবের বিশাল দক্ষযজ্ঞ দেখে মেলা কর্তৃপক্ষের এ পরিসংখ্যান নিয়ে  মনে কোনো সন্দেহ জাগে না। 
আয়োজকদের একজনের সঙ্গে কথা হয়েছিল। বেশ উজ্জ্বল মুখে বলছিলেন তিনিÑ ‘সেমিনার প্রোগ্রাম ইজ দ্য হার্ট অব দ্য ফেয়ার’। নিশ্চয়ই।  একমত না হয়ে পারিনি।
বিশাল সমুদ্রে স্রোতের মতো লোকজনের আসা-যাওয়া। নিচের দুই ফ্লোর জুড়ে বইমেলা। সম্ভবত আন্ডারগ্রাউন্ড। তার ওপরের তলায় বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের নিয়ে পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠানমালা। প্রকাশক এবং প্রকাশনা সংশ্লিষ্টদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। সেখানে লেখক-দর্শক কারও প্রবেশাধিকার নেই।
গোথেনবার্গ বইমেলা দু’হাজার উনিশের থিম কান্ট্রি ছিল দক্ষিণ কোরিয়া। ‘থিম কান্ট্রি’ কনসেপ্টটি কলকাতায়ও দেখেছি। বছর কয়েক আগে বাংলাদেশ ছিল ওদের থিম কান্ট্রি। এটা এমন কিছু নয় একটি দেশকে সম্মান জানানো ছাড়া। বলা হয়, থিম কান্ট্রি করার মধ্য দিয়ে দেশটির কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরা হয়। তা সংশ্লিষ্ট দেশের তেমন উল্লেখযোগ্য কৃষ্টি কালচার চোখে পড়েনি। কলকাতা বইমেলাতে না, ওখানেও না।

এটা মনে হয় দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক চাঙ্গা রাখার একটি সাংস্কৃতিক প্রকরণ। পরের বছর দক্ষিণ কোরিয়া এবং সুইডেনের যৌথভাবে দুুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ষাট বছর উদ্যাপন করার কথা। সম্ভবত সে উপলক্ষেই ওদেশকে থিম কান্ট্রি করা হয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, কোরিয়ান পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং অনুবাদ সাহিত্য ইনস্টিটিউশন ছিল মেলার সহযোগী অংশগ্রহণকারী। থিম সেøাগান ছিলÑ ‘সাউথ কোরিয়া জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড মিডিয়া অ্যান্ড ইনফরমেশন লিটেরেসি।’

দুই.
ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১৩ বছর পর ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড অভারতীয়দের ব্যাকরণনির্ভর বাংলা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যে ছাপা মেশিনের কারণে বাঙালিদের কাছে হ্যালহেড স্মরণীয় হয়ে আছেন সেই ছাপা মেশিনের বিবর্তনের সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রকাশনা জগৎ আজ অনেক বিকশিত। অনেক বেশি প্রফেশনাল। 
‘প্রকাশনা শিল্প’ কথাটা অনায়াসে উচ্চারণ করা যাচ্ছে। এর পেছনে অমর একুশে বইমেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এ শিল্পের গতি দ্রুত বাড়িয়েছে। প্রকাশনার পেছনের কাজ ও ঝামেলা অনেক কমেছে। খুব অল্প সময়ে বাজারজাত করা যায় বলে প্রচুর বই বাজারে আসছে। ভেতরে বিষয় যাই থাক প্রকাশনার মান বেড়েছে, প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে। শিক্ষিত তরুণরা এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এতে আধুনিকতার ছোঁয়া আছে পুরো মাত্রায়।

স্বাধীনতার আগে ও পরে নানা সংকট পেরিয়ে প্রকাশনা শিল্প এগিয়ে চললেও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এক লাফে একে এগিয়ে দিয়েছে অনেক দূর। টেলিভিশনের ঝড়ো হাওয়ার ঝাপ্টায় চেনা পরিবেশ অচেনা হয়ে ওঠা ও তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে বারবার সেই প্রশ্নটিই উঠেছে- বই কি হারিয়ে যাবে? ভেঙে পড়বে কি প্রকাশনা শিল্পের ভিত? সব আশঙ্কা পাশ কাটিয়ে প্রকাশনা শিল্পের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করেছে যে, বই হারাবে না।

প্রযুক্তির বিকাশে বই অন্তরায় নয়। বরং এর ব্যবহার বইয়ের উৎকর্ষ বাড়িয়েছে। বই উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের পেশাদার হওয়ার সুযোগ হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিয়েছে। লেখার এবং কেনার প্রবণতাও এতে বেড়েছে। যে কেউ যে কোনো বিষয় নিয়ে লিখছে। কিছু লিখলেই তা নিখুঁত বই হয়ে আসছে সহজেই। এই বিপুলসংখ্যক বই চিন্তা বা মননশীলতার জগতে কি অবদান রাখছে তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলেও প্রকাশনা শিল্প বিকাশে অবদান রাখছে। যার অর্থ বই এক লাভজনক পণ্যে পরিণত হচ্ছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বইমেলা হিসেবে পরিচিত ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা প্রকাশকদের মেলা। প্রায় পঁাঁচশ’ বছরের পুরনো এ আন্তর্জাতিক বইমেলার প্রথম তিনদিন বরাদ্দ প্রকাশক এবং প্রকাশনার সঙ্গে জড়িতদের জন্য। এ তিন দিন অন্য কারও মেলায় প্রবেশ নিষেধ। বছর কয়েক আগের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দু’হাজার নয় সালে এ মেলায় চার লাখের মতো বই এসেছিল। অংশ নেওয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল তিনশ’ চৌদ্দ। এসব পরিসংখ্যান বইয়ের অগ্রগামী অভিযাত্রার চিত্রই তুলে ধরে।
পৃথিবীর সাত হাজারের বেশি জীবিত ভাষার মধ্যে বাংলার অবস্থান ষষ্ঠ। একই ভাষা গোষ্ঠীর ফরাসি বা জার্মান ভাষীরা সংখ্যায় অল্প হয়েও নিজেদের ভাষায় জাতীয় জীবন নিয়ন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিকভাবে উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে আছে। পৃথিবীতে এখন ফরাসি ভাষায় কথা বলছে ছয় কোটি আশি লাখ মানুষ। জার্মান ভাষায় নয় কোটি আর বাংলায় কথা বলছে আঠারো কোটি দশ লাখের বেশি মানুষ।

পরিসংখ্যানেই কেবল ফার্সি ও জার্মানের দ্বিগুণ বা তার বেশি এগিয়ে আছে বাংলা। কাজকর্মে পিছিয়ে আছে যোজন যোজন দূর। আমাদের ঔপনিবেশিক পূর্বসূরিতা এর অন্যতম কারণ। আমাদের পুঁজির শক্তি নেই। ভাষার কণ্ঠও তাই ক্ষীণ। ইংরেজরা ভারতে আসার আগে ভারত ও চীনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা প্রায় একই ধরনের ছিল।

কিন্তু চীনে ঔপনিবেশিক আধিপত্য ঢুকতে না পারায় আজ তারা বিশ্বে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে যাচ্ছে। তাদের ভাষাকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলোও। আর আমরা আজও রাজনীতি অর্থনীতির সবকিছুতে ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার নিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি। যার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-সাহিত্যেও পড়েছে। 
এ অবস্থা কি চলতেই থাকবে? সেই যে আঠারো শতকে কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফাঁদে আটকে ভূস্বামীদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেনÑ ‘এদের মনে পরিবর্তনের কোনো রকম ইচ্ছা জাগতেই পারে না’। আমাদের শাসক শ্রেণির জমিদাররা এই দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বেরোতে পারেননি আজও।

এ হীনম্মন্যতা থেকে বেরোতে শিক্ষা-দীক্ষা আত্মমর্যাদার বোধ বাড়াতে হবে। আর এর সঙ্গে ভাষা-সাহিত্য বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং সাহিত্যকে যারা ছাপার অক্ষরে মানুষের হাতে পৌঁছে দেন তারা ব্যবসায়ে অবদান রাখার পাশাপাশি নিজেদের দায়িত্বের গুরুত্বও বুঝবেন এমন সংগত আশা করাই যায়।

×