ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২ মাঘ ১৪৩১

ঢাকা ক্লাবের সরকার ও জনগণের প্রত্যাশা

মাহবুব নাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

প্রকাশিত: ১৭:৫০, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঢাকা ক্লাবের সরকার ও জনগণের প্রত্যাশা

ছবিঃ সংগৃহীত

ঢাকায় দামি দামি গাড়িতে চড়ে, মাঝেমধ্যে হেলিকপ্টারে ঘুরে, এলিট ক্লাসের মানুষের সঙ্গে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে দেশ চালানো যায় না। দেশ চালাতে হলে মানুষের কাতারে নামতে হয়, মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, গায়ে কাদা-মাটি লাগাতে হয়। আমরা এমন কাউকে আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চাই, ঢাকা ক্লাবের সরকারকে নয়।


ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি এবং নতুন সরকারের অভ্যুদয় এক অভূতপূর্ব ঘটনা। বাংলাদেশের মানুষ নতুন এক আশার আলো দেখেছিল। এ সরকারকে বিপুল জাতীয় সমর্থন দিয়েছিল জনগণ। অভ্যুত্থানকারীরা ক্ষমতায় বসার পর যে আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের জন্য সরকার কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে, সেটাই এখন প্রশ্ন। বাস্তবতার নিরিখে মানুষ হয়ত ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এ সরকার যে জনগণের সরকার আর হবে না, তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। মানুষ এখন হয়ত এটা ভাবতে শুরু করেছে যে অন্তত একটা নির্বাচন আয়োজন হোক। নির্বাচিত সরকার আমাদের চাহিদার নিমিত্তে কাজ না করুক, অন্তত ভোট দিয়েছি—এই শান্তিটুকু তো থাকবে।


সরকারের বয়স ছয় মাস পার হয়ে গেছে। ছয় মাস খুব বেশি সময় নয়, আবার কম সময়ও নয়। শুরু থেকেই নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে নতুন সরকারকে। পুলিশি নির্যাতন, শ্রমিক বিক্ষোভ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ওপর আক্রমণ, মাজার ও দরবার শরিফ ভাঙচুর, নারীদের খেলাধুলায় বাধা—এসব নানা ইস্যুতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত। এসবের কিছু কিছু অবশ্য পতিত স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্রও বটে। কিন্তু এই সরকারের আমলে আগের ফ্যাসিবাদী শাসনের মতো পুলিশ বেপরোয়া লাঠিচার্জ করবে, এমনটা কেউ আশা করেনি।
সিপিডির গবেষণা বলছে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমার পরও দেশের বাজারে তা বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। কৃষক কম দামে ধান বিক্রি করলেও ভোক্তাকে চড়া দামে চাল কিনতে হয়েছে। অথচ সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল বাজার সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি।


সরকারের কার্যক্রম মূলত দুটি বড় দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত ছিল—এক. অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা, দুই. ফ্যাসিবাদের সব অবশিষ্ট অংশ চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া। তবে বাস্তবে দেখা গেছে, সরকার উভয় ক্ষেত্রেই ব্যর্থ। নিহতদের জন্য ‘জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ গঠিত হলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ফাউন্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সারজিস আলমের পদত্যাগের কারণে এটি কার্যকর হতে পারেনি। অন্যদিকে, ফ্যাসিবাদের দোসরদের দমন ও বিচারের পরিবর্তে তাদের পুনর্বাসনের ঘটনাও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
অনেকে দেখলাম খুব সহজে পালিয়ে গেছে, প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে পালিয়েছে অনেকে। যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, তাঁদের চেহারায় চাকচিক্য—যেন তাঁদের কোনো ভয় নেই, কোনো চিন্তা নেই। কেউ কেউ আবার ফেসবুক ব্যবহার করছে! এর মধ্যে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, যার দায় সম্পূর্ণভাবে বর্তমান সরকারের নিরুত্তাপ নীতির।


সরকারি বিভিন্ন কমিশন ও সংস্কার কমিটিতে এমন ব্যক্তিদের রাখা হয়েছে, যাঁরা অতীতে ফ্যাসিবাদী সরকারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মিডিয়া সংস্কার কমিশনেও এমন নাম দেখা গেছে। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের সাবেক মন্ত্রী-এমপি এবং তাঁদের আত্মীয়স্বজনের নামও সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলা একাডেমি পুরস্কারের ক্ষেত্রেও ফ্যাসিবাদী শক্তির সংশ্লিষ্টতা লক্ষ করা গেছে। এটি সরকারের আদর্শিক দৃঢ়তার অভাবকে স্পষ্ট করে। পুরস্কার ঘোষণা করে জনরোষের মুখে আবার তা প্রত্যাহারও করা হয়েছে। বইমেলা আয়োজনেও সরকারের যথেষ্ট আগ্রহের ঘাটতি দেখা গেছে।


সরকার আমলাতন্ত্র সংস্কারের ক্ষেত্রে তেমন কোনো দৃঢ় অবস্থান নিতে পারেনি। শুধু কয়েকজন আমলাকে সরিয়ে দিলেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব নয়। প্রয়োজন প্রশাসনিক কাঠামোর আমূল সংস্কার। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে এবং সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে এখনো অনেকের অফিসে শেখ মুজিবের ছবি বিদ্যমান।


অন্যদিকে, দেশের অর্থনৈতিক সংকটও ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, অথচ সিন্ডিকেট ভাঙার কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টারা জনগণের মাঝে না গিয়ে হেলিকপ্টারে চড়ে নানা স্থানে যাচ্ছেন, যা অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধি করছে। এমন অবস্থা হয়েছে যে, শীতবস্ত্র বিতরণে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু শীতবস্ত্রের খরচের চেয়েও হেলিকপ্টারের খরচ বেশি! সরকারের এক উপদেষ্টা সুপারিশের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সরকারের উপদেষ্টাদের গাড়ি ব্যবহারের অসংগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব, গঙ্গা গেলেই সবাই হনুমান হয়ে যাবে?


সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজনীতিতে আসার বিষয়টি। তারা যদি রাজনৈতিক দল গঠন করে, তবে তাদের উপদেষ্টাদের পদ থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত। বিএনপির মহাসচিব এটি বলায় এক উপদেষ্টা ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, যা অপ্রত্যাশিত। অথচ জামায়াত একই কথা বললেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এতে বোঝা যায়, বিএনপির জনপ্রিয়তা নিয়েই মূলত শঙ্কা রয়েছে।


বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের কথা বলে আসছে। ২০১৭ সালে ‘ভিশন ২০৩০’ এবং ২০২৩ সালে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। অথচ এখন সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল নেওয়া হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। সংস্কার ও নির্বাচন পরস্পরবিরোধী নয়, বরং উভয়ই একসঙ্গে চলতে পারে। রাজনৈতিক সমন্বয় না থাকলে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন সম্ভব নয়। যদি নির্বাচনের আগে সংস্কারের নামে বিলম্ব করা হয়, তাহলে সেটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হবে।


সরকারকে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে যেতে হবে, সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। ঢাকা ক্লাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে জনসম্পৃক্ততা হারিয়ে যাবে। প্রশাসন এখনো সক্রিয় হয়নি, আমলারা এখনো স্বচ্ছভাবে কাজ করছে না। ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচন আয়োজনের সময় থাকলেও এর মধ্যে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে।
বর্তমান সরকারের প্রতি আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি রয়েছে, যা জনগণের স্বার্থে অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। শেখ হাসিনাসহ যে-সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী অতীতে গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের উপযুক্ত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি, আন্দোলন-সংগ্রামে আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা এবং নিহতদের পরিবারের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।


দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সিন্ডিকেট ভাঙা ও ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয়। পাশাপাশি সংখ্যালঘু, নারী, শ্রমিক ও আদিবাসীদের ওপর হামলার যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।


সরকারকে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করতে হবে, যাতে জনগণের প্রকৃত মতামত প্রতিফলিত হয়। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সরকার কার্যকর সিদ্ধান্ত নেবে—এই প্রত্যাশাই আমরা করি।

জেআই

×