ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১ মাঘ ১৪৩১

মুদ্রাস্ফীতিই অর্থনীতির দুরারোগ্য

মো. হাসিব আহমেদ

প্রকাশিত: ২০:১৮, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

মুদ্রাস্ফীতিই অর্থনীতির দুরারোগ্য

কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানের দ্রব্য বা সেবার মূল্য বৃদ্ধি এবং টাকার অঙ্কের মান কমে যাওয়াকেই অর্থনীতির ভাষায় মুদ্রাস্ফীতি বলে। সাধারণত মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসকেই মুদ্রাস্ফীতি বলে অভিহিত করা হয়। সুতরাং যখন দামের সাধারণ স্তর বৃদ্ধি পায়, তখন প্রতিটি আর্থিক ইউনিটের সামগ্রিকভাবে পণ্য পরিষেবার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। বাজার ব্যবস্থায় পণ্যদ্রব্যের জোগান চাহিদার সামঞ্জস্যতা না থাকলে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপানো হলেই তবে অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব পড়ে। মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতির স্বাভাবিক অবস্থা হলেও অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির জন্য দুরারোগ্য বলেও অভিহিত করা যেতে পারে।

প্রধানত চাহিদাজনিত মূল্যজনিত কারণ দুটিই মুদ্রাস্ফীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। চাহিদাজনিত মুদ্রাস্ফীতি বলতে বোঝায় কোনো কালপরিধিতে জোগানের পরিমাণের তুলনায় চাহিদার পরিমাণের যে বৃদ্ধি হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সবজি চারার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৩,৩৮,০০০ টন এবং অর্জন ৩৮,৫৭,৪৮৬ টন যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৮৯ শতাংশ। সুতরাং এই ঘাটতিই চাহিদাজনিত মুদ্রাস্ফীতি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হবে। অন্যদিকে যদি পণ্য বা পরিষেবার মূল্য বৃদ্ধির কারণ হয় অতিরিক্ত বহন খরচ, অতিরিক্ত গুদামভাড়াসহ সামগ্রিক অতিরিক্ত খরচ তাহলে সেটাকে মূল্যজনিত মুদ্রাস্ফীতি বলে। এই ধরুন বহন খরচ, গুদামভাড়া ক্রমান্বয়ে ৫০-১০০ টাকা করে বেড়ে গেল, তাহলে ভোগ্যপণ্য এবং সেবাসামগ্রীর দাম সামগ্রিকভাবেই বৃদ্ধি পাবে। তা ছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পণ্যদ্রব্য পরিষেবার চাহিদা-জোগানের অসামঞ্জস্যতা এবং মুদ্রানীতি, যার অভ্যন্তরেই বাজারে অতিরিক্ত মুদ্রার জোগান।

মুদ্রাস্ফীতি ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে, অতিরিক্ত সুদের হার বৃদ্ধি করে, আয়ের অসম বণ্টন করে, লোনের বা কজ্জের অতিরিক্ত মূল্য ধার্য হয়, সামগ্রিকভাবে সেভিংসয়ের পরিমাণ হ্রাস পায়, মজুরির মূল্য হ্রাস পায় এবং করের হারের বৃদ্ধি ঘটে। মুদ্রাস্ফীতিতে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা হুমকির মুখে পড়ে। কারণ সময়ে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। অন্যদিকে ধনী, ব্যবসায়ী বা উৎপাদক শ্রেণিই লাভবান বেশি হন। স্থির বেতন বা স্বল্প পরিবর্তনশীল মানুষেরও সময়ে বেহাল দশা হয়। কারণ মুদ্রাস্ফীতির সময় বছর শেষে অপরিবর্তিত বেতন বা সামান্য পরিবর্তিত বেতনের মানুষের জনজীবন হুমকির মুখে ফেলে। যারা ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর নির্ভরশীল তারাও ক্ষতিগ্রস্তদের বাইরে নন। মুদ্রাস্ফীতির সময় ঋণগ্রহীতারা উপকৃত হলে ঋণদাতারা অর্থের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। ছাড়াও আমদানি-রপ্তানি, উৎপাদন কর্মসংস্থান গোপনীয় মজুতের কারণেও মুদ্রাস্ফীতি ঘটে এবং জনজীবনে এর প্রভাব লক্ষণীয়।

আর্থিক নীতি, রাজস্বনীতি এবং অন্যান্য নীতির মাধ্যমেই সরকার সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়। মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণই টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি। আর এই অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধির মূল কারণই হলো ব্যাংকের অতিরিক্ত ঋণ প্রদান। যদি এই ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে অবশ্যই টাকার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ থেকে সহজতর হবে। এই আর্থিক নীতি প্রণয়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক সুদ হার বৃদ্ধি, খোলাবাজার নীতি এবং সংরক্ষণের হার বৃদ্ধির বিষয়গুলোতে আলোকপাত করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকে যে হারে ঋণ দেয় সেটাই মূলত ব্যাংক হার নীতি। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংককে উচ্চহারে ঋণ দেয় তাহলে বাণিজ্যিক ব্যাংককেও তার গ্রাহকদের উচ্চহারে ঋণ দিতে হয়। ফলে অধিকাংশই ঋণ গ্রহণে অনুৎসাহিত হয় এবং ঋণের পরিমাণ হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত হয়। খোলাবাজার নীতি এমন একটা নীতি, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলা বাজারে সরকারি ঋণপত্র বিক্রয় করে অর্থের জোগান কমিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে। খোলাবাজার নীতিতে খোলাবাজারে ঋণপত্র বিক্রয় করলে গ্রাহকরা তাদের নিজ নিজ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর চেক কেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাওনা মিটিয়ে থাকে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আস্তে আস্তে ঋণদানের ক্ষমতা হারায় এবং এভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা খোলাবাজার নীতির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে। সংরক্ষণের হার বৃদ্ধি বলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য নগদ জমার পরিমাণ বা সংরক্ষণের অনুপাত বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের তারল্য হ্রাস পায় এবং ঋণদানের ক্ষমতা কমে আসে। অতঃপর বাজারে মুদ্রার জোগান হ্রাস পায়, ক্রয়ক্ষমতা কমে, দামস্তর কমে এবং মুদ্রাস্ফীতি হার কমে। বর্তমান অর্থনীতিতে আর্থিক নীতি থেকেও রাজস্বনীতির মিকার তারতম্য তুলনামূলক লক্ষণীয়। অতিরিক্ত ব্যয়ের ফলেই মুদ্রাস্ফীতি দেখা যায়। ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যয়ের পরিমাণ কমানোর মাধ্যমেই রাজস্বনীতি বাস্তবায়ন করে। সরকারি খাতে ব্যয় কমানো গেলে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করার ব্যাপারটা আরও সহজতর হয়। তাই সরকার দেশের সামগ্রিক অনুন্নত এবং অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়ের তারতম্য কমানোর মাধ্যমে আর্থিক প্রবাহ সামগ্রিক চাহিদা হ্রাস পায়। ফলে দাম স্তর কমে এবং মুদ্রাস্ফীতিও হ্রাস পায়। সরকারিভাবে অতিরিক্ত করারোপ এবং নতুন নতুন পণ্য বা সেবা সামগ্রী এর ওপর করারোপ করে জনসাধারণের চাহিদা কমানোর মধ্য দিয়ে দামস্তর কমানোসহ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। উৎপাদন কম হলে খরচজনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটে, তখন পণ্য বা সেবার খরচ বাড়ে ফলে দাম স্তরও বাড়ে। তাই সরকার যদি ভর্তুকি দেয় তাহলে খরচজনিত মুদ্রাস্ফীতি আস্তে আস্তে লাঘব হবে।

মুদ্রাস্ফীতির সময় সরকার ব্যক্তি, মালিক বা প্রতিষ্ঠান থেকে অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে দেশের আয়ের স্তর কমানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশের সামগ্রিক চাহিদা বাড়ায়, দামস্তর কমায় এবং অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি প্রত্যাখ্যাত হয়। আর্থিক রাজস্বনীতি ব্যতীত সরকার সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, ন্যায্যমূল্যে বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন, মজুরি নিয়ন্ত্রণ, আমদানি বৃদ্ধি, গচ্ছিত অর্থ আটক অর্থ অবৈধকরণ এসব পদক্ষেপের বদৌলতেও অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস বা সামগ্রিক জোগান চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণের মাধ্যমে পণ্য বা পরিষেবার দাম বেঁধে দেওয়া হয় এবং এই দামস্তর নির্ধারণ থাকে বলে দ্রব্যমূল্য বা সেবাসামগ্রীর দাম স্থিতিশীল থাকে। কিন্তু যদি কালোবাজারিদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয় তাহলে পরিস্থিতি আরও বিপর্যস্ত হয়।

সামগ্রিকভাবে দেশের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ উৎপাদন করতে পারলে বাজারে দ্রব্যসামগ্রী পরিষেবার জোগান বৃদ্ধির মাধ্যমেও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। যদি সরকার ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে কিছু স্থানে বিক্রয় কার্যক্রম বাড়ায় তাহলে মালিকানা ব্যবসায়ীদের জোট নষ্ট হয়ে মুদ্রাস্ফীতির সুফল বয়ে আনতে পারে। মুদ্রাস্ফীতির সময় সরকার কর্তৃক মজুরির পরিমাণ নির্ধারণ অতীব জরুরি। তার সঙ্গে আমদানি বৃদ্ধি করে বাজারে জোগানের তারতম্য বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতিকে রুখে দেওয়া সম্ভব। গচ্ছিত অর্থ আটকের ব্যাপারটা হলো প্রত্যেকের ক্রয়ক্ষমতার যথার্থতা রক্ষার জন্য করা হয়। সময় যাতে ধনী ব্যক্তিরা দরকারের অতিরিক্ত খরচ না করতে পারে তাই সরকার ব্যাংক কর্তৃক তাদের নির্দিষ্ট অর্থ সাময়িকভাবে আটক করে রাখে। ফলে বাজারে টাকার জোগান হ্রাস পায়। মুদ্রাস্ফীতি চরম পর্যায় ধারণ করলে অনেক সময় পুরনো অর্থ পরিত্যাগ করে নতুন নোট বাজারে ইস্যু করে বেশি মূল্যের নোটকে অচল করা হয়। অতএব মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের একটি পদক্ষেপ না নিয়ে, সামগ্রিকভাবে সকল পদক্ষেপ নিলেই অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস এবং সামগ্রিকভাবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ছাড়াও সাধারণ মুদ্রাস্ফীতির ফলে সম্পদের মূল্য বৃদ্ধি, মজুরির সামঞ্জস্যতা, ব্যয় বৃদ্ধি, চাহিদা বৃদ্ধি, লাভের পরিমাণ বৃদ্ধির ন্যায় সামান্য কিছু সুবিধাও পরিলক্ষিত হয়। মধ্যমপন্থীয় মুদ্রাস্ফীতি তখনই ঘটে যখন পণ্য এবং পরিষেবাগুলোর জন্য সামগ্রিকভাবে শক্তিশালী চাহিদা থাকে এবং এই বর্ধিত চাহিদা উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের উচ্চ স্তরের দিকে নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং বলা যেতে পারে মধ্যমপন্থনীয় মুদ্রাস্ফীতিই হতে পারে একটি অর্থনীতির সুস্থ এবং স্বাভাবিক অবস্থা।

 

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

[email protected]

×