ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১ মাঘ ১৪৩১

গুম-খুনের দ্রুত বিচার চাই

খালিদ ইবনে আমিন

প্রকাশিত: ২০:১২, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

গুম-খুনের দ্রুত বিচার চাই

গুম-খুনের নির্দেশদাতা ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সম্প্রতি এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এলেইন পিয়ারসন। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনা বা তার সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জানতেন। অনেক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরাসরি গুম ও হত্যার নির্দেশও দিয়েছিলেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত ‘আফটার দ্য মুনসুন রেভল্যুশন আ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ৫০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সরকারকে মূল কাঠামোগত সংস্কারের ওপর জোর দেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে। আটকের ক্ষেত্রে আইন অনুসরণ এবং সমালোচকদের দমনের জন্য ব্যবহৃত আইন বাতিলের পাশাপাশি গণগ্রেপ্তার ও প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বন্ধ করার তাগিদও দিয়েছে সংস্থাটি। রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমে জড়িত থাকায় বিশেষায়িত বাহিনী র‌্যাবকে বিলুপ্তির সুপারিশ ও বিনা বিচারে কাউকে আটক বা বন্দি রাখা বা গুম করা সম্পূর্ণ বেআইনি। একই সঙ্গে তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনসহ মানবতা ও মানবাধিকারের পরিপন্থি। অন্তর্র্বর্তী সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ইতোমধ্যে গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠন করেছে। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের গুম ও নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষরও করেছে বাংলাদেশ। তৃতীয় বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ন্যায় বাংলাদেশেও গুম, খুন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্য ঘটনায় জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার নজির নিকট ইতিহাসে নেই বললেই চলে।
সর্বশেষ জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তাদের সঙ্গে থাকা আওয়ামী নেতা-কর্মী ও তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগী প্রান্তিক পর্যায়ের টোকাই সন্ত্রাসীদের নির্বিচার গুলির ঘটনা ভিজুয়াল মাধ্যমে বিশ্ববাসী দেখেছে। রাষ্ট্রের র‌্যাব-পুলিশ ও দলীয় গৃহপালিত সন্ত্রাসীদের অতীত অপরাধের অলিখিত দায়মুক্তি দেওয়ায় এই মাত্রার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় না আনায় নানামুখী অপরাধে জড়িয়েছে তারাও। দেশের টপ টু বটম কারও কোনো ধরনের জবাবদিহি না থাকায় মানবাধিকার পরিস্থিতি বৈশ্বিক মানে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। বিচার পাওয়ার অধিকার নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে অধিকাংশ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা স্বীকার করা হয়নি। নানা অজুহাতে বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঠিক তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নাগরিকদের সুরক্ষিত রাখা যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃসাশনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।  ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও তাদের স্বজনদের বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভুক্তভোগীদের বিচারের দ্বার উন্মুক্ত হতে থাকে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রয়োজন আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলের সকল গুম, নির্বিচারে গুলি করে মানুষ খুন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বেশিরভাগ সময়ই অস্বীকার করা হয়েছে। ফলে বিচার প্রক্রিয়াও হয়েছে বাধাগ্রস্ত। এ অবস্থায় মানবাধিকার পরিস্থিতির টেকসই সুরক্ষার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অতীত অপরাধগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার করা প্রয়োজন।
গুম-খুনে গত দেড় দশকে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কতটা নাজুক হয়েছে এর জ্বলন্ত উদাহরণ আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ বেশকিছু সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী শেখ হাসিনার টানা গত তিন মেয়াদে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিনা বিচারে ১ হাজার ৯২৬ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। গুম হয়েছেন সাতশতাধিক। এখনো প্রায় ২০০ জন নিখোঁজ। এর বাইরে পতিত সরকারের শেষ সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সর্বজনীন মানবাধিকার সুরক্ষিত রাখতে জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডসহ অতীতের সকল গুম ও হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার করতে হবে।  যদি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ ধরনের অভিযোগ আসে সেগুলোও শুনতে হবে। দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গুমের ঘটনাগুলো তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো কমিশন হয়নি। এ বিষয়ে সরকারের বিশেষ কোনো পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের ভাষ্য মতে, ‘মানবাধিকার সুরক্ষিত রাখতে জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডসহ অতীতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিচার করতে হবে। শুধু অপরাধীদের সাজাই নয়, ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এখনো যদি কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আসে সেগুলো শুনতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে তা স্বীকার করতে হবে এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে’।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে রাজধানীর উত্তরার চারতলার বাসার বারান্দায় নিহত হয় এসএসসি পরীক্ষার্থী নাঈমা সুলতানা। তার মায়ের দাবি, ‘যেভাবে পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারা হয়েছে তার বিচার হতেই হবে। এদের এমন বিচার হতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ যেন কারও মায়ের বুক খালি করতে সাহস না পায়।’ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান কাজ হলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্ত করা। মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯-এর ১২ ধারা অনুযায়ী সঠিকভাবে অভিযোগগুলোর নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অভিযোগের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কমিশনে ১৩ হাজার ২৮টি অভিযোগ জমা পড়ে, যার অধিকাংশই নিষ্পত্তি হয়নি। যেগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে তা নিয়েও  রয়েছে নানা ধরনের  অভিযোগ। অনেক সময় দায়সারাভাবে অভিযোগ নিষ্পন্ন করেছে। কমিশনের বিরুদ্ধে আইনে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা প্রয়োগ না করার অভিযোগও রয়েছে। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট এক রায়ে মন্তব্য করেছেন, মানবাধিকার কমিশন তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালনে মারাত্মক গাফিলতির পরিচয় দিচ্ছে। কমিশন মানবাধিকার রক্ষায় ‘জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে’। অনেক অভিযোগ স্বীকারও করেনি তারা। ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়ন অংশে গুমের বিষয়ে আলাদা করে কিছু বলা হয়নি; বরং নিখোঁজ/অপহরণের পাশে বন্ধনী দিয়ে লেখা হয়েছে ‘কথিত গুম’।
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিচার পাওয়া নিয়ে নানা সংশয় রয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এ সংশয়  তৈরি হয়েছে কয়েকটি কারণে। অনেক ঘটনায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে জটিলতা দেখা দেয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পর্যাপ্ত সহযোগিতা করছে না। অন্তর্র্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনে ১ হাজার ৬০০ অভিযোগ জমা পড়েছে।  পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এসব ঘটনায় জড়িত। এরা মূলত মধ্যম সারির কর্মকর্তা। বিভিন্ন সময় গুমের পরিকল্পনাকারী কিংবা মাস্টারমাইন্ড হিসেবে যাদের নাম এসেছে তারা সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অনেকে দেশ ছেড়েছেন। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করা সহজ নয়। এছাড়া গুমের অনেক আলামত ধ্বংস করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অতীত ঘটনাগুলোর বিচার না হলে আগামী দিনে মানবাধিকার রক্ষার পথ সংকুচিত হয়ে যাবে। গুমের ঘটনাগুলোর বিচারে পৃথক আইন বা বিদ্যমান আইনের এ সংক্রান্ত ধারাগুলো সময়োপযোগী করা যেতে পারে। এ অবস্থায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলোয় রয়েছে শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা। গত সাড়ে ১৫ বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুষ্ঠু বিচার না হলে ছাত্র-জনতা যে নতুন বাংলাদেশের চিন্তা করছে তা স্বপ্নই থেকে যাবে। গুমের ঘটনায় তদন্ত কমিশন হলেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তথ্যানুসন্ধানে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই বাস্তবতায় পতিত আওয়ামী সরকারের দেড় দশকের শাসনকালে বিচারবহির্ভূত ১ হাজার ৯২৬ জনের হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশে র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ। বহু বছর ধরে র‌্যাব নির্যাতন করে আসছে এমন তথ্য-উপাত্ত সংস্থাটির কাছে রয়েছে। দাতাদের অর্থায়নের বাহিনীটিকে মানবাধিকারের প্রশিক্ষণ দিলেও কোনো কাজে আসেনি বলে মনে করে সংস্থাটি। দাতাদের এ বাহিনীর পেছনে অর্থ খরচ করাকে ভুল বলছে এইচআরডব্লিউ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় নজিরবিহীন দমনপীড়ন চালানো হয়েছিল। এ ধরনের অতিরিক্ত বল প্রয়োগ বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সুপ্রতিষ্ঠিত অনুশীলন, যারা দীর্ঘ সময় ধরে দায়মুক্তির অপসংস্কৃতি উপভোগ করে আসছে। ২০১৯ সালে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে ‘রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছিল। পুলিশসহ বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়মুক্তি ও জবাবহীনতার বিষয়টিও প্রতিষ্ঠিত। শেখ হাসিনা যখন দেশ ছেড়ে চলে যান তখন বহু থানা ভূতুড়ে ভবনে পরিণত হয় এবং জনরোষের ভয়ে পুলিশ সদস্যরা গা ঢাকা দিয়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় কী মাত্রায় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। পুলিশ ও র‌্যাবের মধ্যে যারা হিংস্র মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।  সমাজবিজ্ঞানীগণ মনে করেন রাষ্ট্রের মধ্যেই রয়েছে নিপীড়নের হাতিয়ার। আমরা মনে করি একটি সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ভবিষ্যতে আর কোনো সরকারের আমলেই যেন এ ধরনের বর্বরোচিত ঘটনা না ঘটে তা সুনিশ্চিত করার এখনই উপযুক্ত সময়। তা সুনিশ্চিত করতে হবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
লেখক : সাংবাদিক

×