প্রতিকী ছবি
চিকিৎসা মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহের মধ্যে অন্যতম। প্রতিটি নাগরিকের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। বাংলাদেশ যক্ষ্মা টিকাদান কর্মসূচি, কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি, কালাজ্বর নির্মূলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি সাফল্য অর্জন করলেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জন, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সূচকে অনেক পিছিয়ে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা ইনডেক্স ১০০এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৫২, যা ২০৩০ সালে কমপক্ষে ৮০ তে উত্তীর্ণ করতে হবে। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমপক্ষে ৭৩ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বৈশ্বিক সুযোগে বাংলাদেশের স্কোর ১০০ এর মধ্যে ৩৫.৫। এছাড়াও ১৯৫ দেশের মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থান ৯৫ তম। অন্যদিকে, অন্তর্ভুক্তিমূলক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে (স্কোর ৩০.৮)
বাংলাদেশ স্বাস্থসেবায় জনবলের ক্ষেত্রে সংকটাপন্ন ৫৭টি দেশের একটি। এখানে ডাক্তার, নার্সের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত অনুপাতে ১:.৪৮, যা অনাকাক্সিক্ষত। ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্য জনশক্তির স্বীকৃত অনুপাত ১:৩:৫ হলেও আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। স্বাস্থ্যসেবার পূর্ণতা অর্জনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতে অর্থের সংকুলান ও ব্যবস্থাপনার প্রচন্ড অভাব। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের মাত্র ৭ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। যা জিডিপির মাত্র ২. ৩৬% এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কম। বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ মাথাপিছু মাত্র ৫ ডলার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য সেবায় মাথাপিছু ৩৪ মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হবে। এখানে স্বাস্থ্যসেবা খাতে সরকারি ব্যয় থেকে ব্যক্তিগত ব্যয় কয়েকগুণ বেশি। ২০২২ সালে ৭৩ শতাংশ ব্যক্তিগত ব্যয় হয়। অপরদিকে ২০২২ সালের স্বাস্থ্যবিষয়ক এক প্রতিবেদনে দেখা যায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্য চিকিৎসায় ব্যক্তিগত কম খরচ মালদ্বীপে- সেখানে এই ব্যয়ের মাত্র ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ ব্যক্তিকে বহন করতে হয়, বাকি অংশ সরকার বহন করে। এরপর ব্যয় সবচেয়ে কম ভুটানে, সেখানে জনপ্রতি ব্যয় হয় ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় এই ব্যয় ৪৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, ভারতে ৪৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, নেপালে ৫১ দশমিক ৩০ শতাংশ আর পাকিস্তানে ৫৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। ফলে প্রতিবছর ৩.৭% লোক দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য সূচকে আমাদের বর্তমান অবস্থান নিশ্চয়ই অগ্রসর। অন্যদিকে এই সূচকে বৈশিষ্ট্যগুলো যে বার্তা দেয় তা হলোÑ স্বাস্থ্য গঠন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্তি খাতের ওপর নির্ভর করে না। একটি দেশের স্বাস্থ্যনীতি ছাড়াও দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, ওষুধনীতি, বিচার ব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি অগ্রগতিকেও দারুণ প্রভাবিত করে।
২০০০ সালে প্রথম স্বাস্থ্যনীতি ও ২০১১ সালের দ্বিতীয় স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করা হলেও নেওয়া হয়নি তেমন কোনো উদ্যোগ। এমনকি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি ২০১২ সালে হেল্থ কেয়ার ফাইন্যান্সিং স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়নে। অন্যদিকে, গত দুই দশকে স্বাস্থ্য খাতে কোনো কার্যকর সংস্কার করতে পারেনি সরকার। বরং সংস্কার নামে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দুই ভাগে ভাগ করেছে। এর প্রধান কারণ আমাদের নীতিনির্ধারণী মহলের স্বাস্থ্য খাত এবং স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থা সম্পর্কে নিখাদ ও সামগ্রিক ধারণার অভাব। এই না বোঝার পেছনে তাদের অজ্ঞতা ও দুর্নীতিপরায়ণতাও দায়ী। এ কারণে মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কিংবা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে জনবল, ইকুইপমেন্ট, অর্থায়নের ভিত্তিতে আমরা পূর্ণাঙ্গ ও সক্ষম করে গড়ে উঠতে পারিনি। যার ফলে চিকিৎসায় বিদেশগামিতা প্রবণতা বহুগুণে বেড়ে গেছে। এর অন্যতম কারণ চিকিৎসাব্যবস্থায় বাংলাদেশের মানুষের আস্থার সংকট চরমে। রোগীকে উপযুক্ত সময় ও আন্তরিকতার অভাব চিকিৎসকদের। দ্বিতীয়ত, রোগ নির্ণয়ে দীর্ঘসূত্রতা ও চিকিৎসার সহজলভ্যতার অভাব। এছাড়াও, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির দৌরাত্ম্য। কোম্পানির প্রতিনিধিগণ হাসপাতালগুলোতে গিয়ে ডাক্তারদের নিজ নিজ ফার্মাসিউটিক্যালের মেডিসিন লেখার জন্য প্ররোচিত করে ও মোটা অঙ্কের উৎকোচ প্রদান করে। এতে ডাক্তারগণ রোগীর অবস্থার চেয়ে উক্ত কোম্পানির মেডিসিনের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ দেয়। এমনকি সকল হাসপাতালের বাইরে কোম্পানি প্রতিনিধিগণ প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার জন্য উদগ্রিব হয়ে পড়ে। ফলে রোগী বিরক্ত বোধ করে। রোগী রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে শিকার হয় ভোগান্তির।
বিশেষজ্ঞগণ বলেন, বাংলাদেশী চিকিৎসা ব্যবস্থায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও ডাক্তারের ওপর আস্থা যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে আচার-আচরণে ডাক্তারের মানবিক গুণাবলীর অভাব। বিশেষ যে বিষয়টি লক্ষ্য করা যায় তা হলো-
* বিদেশে স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা করানো যায়।
* উচ্চমানের চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যায়।
* দ্রুত রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা হয়।
* চিকিৎসকের আন্তরিক ব্যবহার।
* পর্যাপ্ত সময় ও মনোযোগ দেন চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
প্রতি বছর দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যান ৯ থেকে ১০ লাখ মানুষ ভারত সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, তুরস্কে। এছাড়াও ইউরোপ-আমেরিকায় যাওয়া প্রবণতা রয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ভারতে প্রতিবছর ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষ চিকিৎসা নেয়, যা সেদেশের মোট জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়া রোগীদের সর্বোচ্চ সংখ্যক হলেন ক্যান্সারের ২১%।
এছাড়াও হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী ১৮ শতাংশ, গ্যাস্ট্রো এন্ট্রোলজি, লিভার, কিডনি, চোখ, কান ও স্নায়ুবিক চিকিৎসার জন্য। বিশেষজ্ঞগণ বলেন, দেশে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে এবং চিকিৎসা খরচ হ্রাস করতে হবে। ডাক্তারের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন জারিসহ যুগোপযোগী স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করতে হবে। চিকিৎসকদের আন্তরিকতা, সঠিক রোগ নির্ণয়, সুলভ মূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ যাবতীয় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।