
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্যসাধারণ সুন্দরবন। আমাদের দেশের জন্য এই প্রাকৃতিক সম্পদ কত বড় সম্পদ সেটা বলে শেষ করা যাবে না। সুন্দরবনের বিশালতা, ব্যাপ্তি, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধিশালী হওয়ায় ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সুন্দরবনকে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কো সৌন্দর্যের স্বীকৃতি দিলেও সুন্দরবনের বাস্তব চিত্র একদম আলাদা। দখল-দূষণ, চোর-ডাকাতের উৎপাতে দিন দিন সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদ কমে আসছে। কমে আসছে বনের পরিমাণ। ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের সুন্দরবন সুন্দরী গাছের ম্যানগ্রোভ। এ জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল দুই বাংলার লাখ লাখ মানুষ। সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য এক বিরাট আয়ের উৎস। এ বনের আশপাশ ঘিরে ৪৫০টির মতো নদী, খাল রয়েছে, যেখান থেকে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি, সাদা মাছ, কাঁকড়া আহরণ করে হাজার হাজার জেলে পরিবার জীবন-জীবিকা চালাচ্ছে। শুধু জীবন-জীবকার চাহিদা পূরণ নয়, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগেও আমাদের রক্ষার জন্য প্রথমেই বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় সুন্দরবন। অথচ আমরা এতই অবিবেচক যে, সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সামান্য তৎপরও নই। সুন্দরবনের বাওয়ালী, মৌয়াল, জেলে থেকে বিভিন্ন পেশার লোক এখানে কাজ করে। হাজার হাজার পরিবার সুন্দরবনকে কেন্দ্র করেই রুটি-রুজির সংস্থান করে। কিন্তু কোনোভাবেই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা হচ্ছে না। বৃক্ষ নিধন থেকে শুরু করে প্রাণ-প্রকৃতি নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে। মানুষের আগ্রাসনে দূষণ বাড়ছে বিশ^খ্যাত ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে। বন সংলগ্ন এলাকায় শিল্প-কারখানা স্থাপন, বনের মধ্য দিয়ে ভারি নৌযান চলাচল, বিষ দিয়ে মাছ শিকার ইত্যাদি এত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, বিষের ব্যবহারে সুন্দরবনের জীবন বিষিয়ে উঠেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বনের গাছপালা, বন্যপ্রাণী ও জলজ প্রাণীর ওপর। সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করলেও সেই এলাকার মধ্যে গড়ে উঠছে শিল্প প্রতিষ্ঠান। গত ৮-১০ বছরে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, এলপি গ্যাস প্ল্যান্ট, অয়েল রিফাইনারি, বিটুমিন, সি ফুড প্রসেসিং ফ্যাক্টরি প্রভৃতি। বনের খুব কাছেই বিশালাকৃতির খাদ্যগুদাম নির্মাণ করেছে খাদ্য বিভাগ। বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পশুর নদে, যা চলে যাচ্ছে বনের মধ্যে নদী ও মাটিতে। সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে দীর্ঘদিন ধরে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে একটি দুষ্টচক্র। এর ফলে বিভিন্ন মাছের পোনা, কাঁকড়া, সাপসহ জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে।
গত পাঁচ বছর ধরে সুন্দরবনের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এক শ্রেণির অসাধু জেলে অবাধে বনের ভেতরের নদী-খালে রিপকর্ড বিষ ঢেলে দিয়ে চিংড়ি মাছ নিধনে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অন্যান্য প্রজাতির মাছও সমূলে নিধন হচ্ছে। ফলে সুন্দরবনে আগের মতো চিংড়িসহ অন্যান্য প্রজাতির মাছের দেখা মিলছে না। পশ্চিম সুন্দরবনের মার্কিখাল, কালিখাল, চালকি, আড়ুয়া শিবসা, ছেড়া, গেওয়াখালি, পাথকষ্টা, হংসরাজ, দুধমুখ, পিনমারা, মুচিখালি, মোল্লাখালি, মান্দারবাড়ি, শাপখালিসহ বনের ভেতরের অন্যান্য নদী-খালে পাস পারমিট ছাড়া অসাধু জেলেরা বিষ প্রয়োগ করে নিষিদ্ধ ভেষালি জাল দিয়ে মাছ শিকার অব্যাহত রেখেছে। কয়রার জোড়শিং, পাথরখালি, ৬ নং কয়রা, ৪ নং কয়রা, মঠবাড়ি, হড্ডা, বানিয়াখালি, কালিবাড়ি, শেখেরকোনা, গোলখালি এলাকার শতাধিক জেলে বর্তমান সুন্দরবনে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকারের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ধুরন্ধর এ সকল জেলে জোয়ার পরিপূর্ণ হলে খালের নিচভাগে ভেসাল জাল পেতে দিয়ে খালের অগ্রভাগের পানিতে রিপকর্ড বিষ বোতল থেকে ছিটিয়ে দেয়। ভাটা শুরু হলে ওপরের অংশের পানি দ্রুত খালের নিচের দিকে ধাবিত হতে থাকে। ফলে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত খালের ছোট-বড় সমুদয় মাছ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মরে লালচে আকার ধারণ করে জালে এসে জড়ো হতে থাকে। অধিক মাছ জালে জড়ো হওয়ায় অসাধু জেলেরা তখন আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ সকল জেলেকে পাকড়াও করতে তৎপর বন বিভাগ। কিন্তু সুন্দরবন অঞ্চলের খাল-নদীতে যে পরিমাণ বিষ প্রয়োগ করা হয় তাতে মনে হয় বন বিভাগ কাঠের চশমা চোখে দিয়ে থাকে। কারণ, বন বিভাগের সতর্কতা তাদের কাজ দিয়েই বোঝা সবচেয়ে সহজ।
বিষ খাল-নদীতে দিলে দ্রুত তীব্র বিষের কারণে ভেসে ওঠে অজস্র মাছ। তাতে তাৎক্ষণিকভাবে লাভবান হওয়া গেলেও অনেক মাছের ক্ষতি হয়। মাছের ডিম, পোনা নষ্ট হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ কাজ করলেও জেলেদের ভাগ্যের কিন্তু পরিবর্তন হয় না। লাভবান হয় আড়তদার ও অর্থলগ্নিকারী বড় বড় মহাজন। ফলে সুন্দরবনের মৎস্যভাণ্ডার নদী-খাল ক্রমশ মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। বিষ প্রয়োগ করায় শুধু মাছই নয়, মারা যাচ্ছে অন্যান্য জলজ প্রাণীও। এতে একদিকে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বনজ সম্পদসহ পরিবেশের ওপর, অন্যদিকে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের। কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরার কারণে শুধু যে সুন্দরবন এলাকার মৎস্যসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, এই বিষাক্ত পানি পান করে বাঘ, হরিণ, বানরসহ অন্য বন্যপ্রাণীরাও মারাত্মক হুমকির মধ্যে রয়েছে। এতে উপকূলীয় এলাকায় মানুষের পানীয় জলের উৎসগুলোও বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। বিষ দিয়ে মাছ শিকারের প্রবণতা বন্ধ করতে হলে জেলেদের মহাজন ও চোরাকারবারি সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় আনতে না পারলে বিষে বিষে নীল হয়ে যাবে ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশ পেলেও কারও যেন কিছু করার নেই। সুন্দরবন এলাকার জেলেদের অভিমত, বন বিভাগের অজান্তে বিষ দিয়ে মাছ শিকার কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর সঙ্গে বনের কেউ না কেউ অবশ্যই জড়িত রয়েছে। এই কথা বললে আবার মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে বিষ প্রয়োগের কারণে সাধারণ জেলেরা তেমন মাছ পান না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে, যাতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন। শুধু ঝড়-জলোচ্ছ্বাসেই নয়, লবণাক্ততা ও উষ্ণতা বৃদ্ধি, অচেনা রোগবালাই আর কীটপতঙ্গের আক্রমণেও দেশের এই অতন্দ্র প্রহরী এখন ক্ষতবিক্ষত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অসাধু মানুষের অত্যাচার। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় দেশের সবচেয়ে বড় রক্ষক সুন্দরবন আজ নিজেই বিপদে। সম্প্রতি একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের অনুসন্ধানে প্রকাশ হয়েছে যে, ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণের পর যে বনদস্যুরা নিষ্ক্রিয় ছিল অসাধু মাছ ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা আবার সুন্দরবনে নেমেছে। এই ডাকাতেরা নির্দিষ্ট কোম্পানি মহাজনের নিয়োজিত জেলেদের সুরক্ষা দেয়, আর অন্যদের মাছ, জাল ডাকাতি করে নিয়ে যায়। এ কারণেই সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরার তৎপরতা বেড়ে গেছে। সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলা বাজারের কীটনাশক বিক্রির দোকানে দেদার বিক্রি হয় নানা ধরনের কীটনাশক। গাছ কিংবা সবজিতে ব্যবহারের কথা বলে ডায়মগ্রো, ফাইটার, রিপকর্ড, পেসিকল নামক কীটনাশকই বেশি কেনে সুন্দরবনের জেলেরা।
সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রার মৎস্য আড়তে বিষ দিয়ে ধরা মাছ বেশি আসে। বিশেষ করে চিংড়ি থেকে বিষের উৎকট গন্ধ বেশি আসে। যে কারণে স্থানীয় মানুষ সুন্দরবনের মাছ খায় না। বিষাক্ত মাছগুলো সব ট্রাকে করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায়। বিভিন্ন জেলা বা ঢাকা যেখানেই যাক বিষাক্রান্ত মাছ খাচ্ছে মানুষ। নানা রোগ দেখা দিচ্ছে বিষ দিয়ে ধরা মাছ খেয়ে। যারা বিষ দেয়, যারা বিষের কথা জানে তারা কেউ এ মাছ খায় না। সুন্দরবন সংলগ্ন বাজারগুলোতে এসব মাছ সবাই চিনতে পারে। কিন্তু বাইরের কেউ চিনতে পারে না। যারা সবকিছু জেনে বিষ দেয় তারা মানুষ হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। তারপরও দিনের পর দিন এই বিষ দিয়ে মাছ শিকার চলছেই। সুন্দরবনের খাল ও নদীতে বিষ প্রয়োগের কারণে বনের ভেতরের অজস্র প্রজাতির উদ্ভিদ ও বিচিত্র সব প্রাণীর ক্ষতি ভয়াবহ আকার নিয়েছে। বিশ্বের আকর্ষণীয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও এ বনে রয়েছে নানা ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী। এসব উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের দ্বারা দেশের পরিবেশের ভারসাম্যও টিকে থাকে। যে কারণে সুন্দরবন আমাদের দেশের ফুসফুসের মতো। দেশের ফুসফুস এখন ভালো নেই। এর ওপর চলছে নানা ধরনের অত্যাচার। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ফলে সুন্দরী গাছ নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতিতে এর ধাক্কা লাগছে। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন ও অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ নিধনের ফলে গত চার দশকে সুন্দরবন প্রায় নিঃস্ব হয়েছে। সুন্দরবনের সৌন্দর্যের প্রতীক সুন্দরী বৃক্ষ কমে গেছে প্রায় ২৮.৭৫ শতাংশ, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। পরিবেশের জন্য প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা একান্ত জরুরি। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এক সময় সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষাই কষ্টকর হয়ে পড়বে।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক