ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০ মাঘ ১৪৩১

রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের চ্যালেঞ্জ

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ১৯:৫৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের চ্যালেঞ্জ

পবিত্র রমজান আসন্ন। বাংলাদেশের সমাজে রমজান একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সময়, যা ধর্মীয় অনুশাসন, উপবাস, ইবাদত এবং পারিবারিক সংহতির প্রতীক। এই মাসে ধর্মীয় শুদ্ধতার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে পরিবারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহের বিষয়টি। রমজান আসার আগেই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা থাকে, বাজারে পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল থাকবে, যাতে তারা শান্তিপূর্ণভাবে এই পবিত্র মাস পালন করতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজারের বাস্তবতা ভিন্ন। বছরের অন্যান্য সময়ে নিত্যপণ্যের মূল্য থাকে নিয়ন্ত্রণহীন, রমজান মাসে তা চরম আকার ধারণ করে। বিশেষ করে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মুনাফালোভী কার্যক্রম সাধারণ মানুষকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে, সরকারি কর্তৃপক্ষের কার্যকর হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেই।
৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার, যার উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে দেশকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়া, তার কার্যকাল প্রায় ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সরকারের কার্যক্রম মূল্যায়ন এখনই সম্ভব না হলেও, নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে তাদের ব্যর্থতা এক বড় সংকট তৈরি করেছে। এর মধ্যে নতুন করে আরোপিত শুল্ক হতে পারে। কর ও ভ্যাট আরও বেশি মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি করছে, যা জনজীবনকে চরমভাবে প্রভাবিত করছে। বিশেষত, রমজানের মতো সংবেদনশীল সময়ে বাজারের এই অস্থিতিশীলতা জনগণের জন্য এক কঠিন পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বজায় রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। পবিত্র রমজানের সময় জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে সরকারি তদারকি এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
রমজান মাসের বাজার পরিস্থিতি মূল্যায়নে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহের বাজার পরিস্থিতি এবং নিত্যপণ্যের দাম ও সেবার মান পর্যালোচনায় দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে রমজান মাস একটি সামাজিক সংহতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সময়ে পণ্যের দাম সাধারণত বিশেষ রীতি নীতি অনুযায়ী স্থিতিশীল রাখা হয়, যাতে জনগণ আর্থিক চাপে না পড়ে। সেখানে ব্যবসায়ী ও বিক্রেতারা প্রায়ই পণ্যদ্রব্যে ছাড় দিয়ে থাকেন, বিশেষ করে খাদ্যপণ্য, কাপড় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীতে। তাদের লক্ষ্য থাকে ন্যূনতম লাভ ধরে রেখে পণ্য বিক্রি করা এবং সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মান জানানো। এই নীতির কারণে সাধারণ মানুষ রমজান মাসে স্বস্তি ও আর্থিক স্থিতিশীলতা অনুভব করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট একেবারে বিপরীত। এখানে রমজান মাসে পণ্যের দাম স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়, যা সাধারণ মানুষের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। দেশের অধিকাংশ বাজারে ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটগুলোর আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়, যারা রমজানের ধর্মীয় মহিমাকে উপেক্ষা করে মুনাফা বৃদ্ধিতে মনোযোগী হয়। বিশেষত, রমজান ও ঈদের সময় এসব ব্যবসায়ী নিজেদের লাভের পরিমাণ বাড়ানোর সুযোগকে কাজে লাগায়। ফলে, পণ্যের মূল্য এতটাই বেড়ে যায় যে, তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। সারাদিন সিয়াম সাধনের পর ইফতারের জন্য নূন্যতম খাবার কেনা ও সেহরির ব্যবস্থা গ্রহণ অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার না দিয়ে নিজেদের আর্থিক স্বার্থকে প্রধান করে তোলে। এর ফলে বাজারে ন্যায্য দরদামের অভাব তৈরি হয়, যা রমজানের মতো সংবেদনশীল সময়ে অস্থিরতা আনে জনজীবনে।
এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশে একটি কার্যকর বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি আরও সচেতন হওয়া জরুরি। সরকারকেও বাজার মনিটরিং প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে এবং সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই রমজান মাস বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য প্রকৃত অর্থে স্বস্তি ও শান্তি নিয়ে আসবে।
রমজানের আগে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের বাজার ব্যবস্থায় ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। কারণ, সরকারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর না হওয়ায় সিন্ডিকেটের অপব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা খুবই সহজ এবং যৌক্তিকÑ রমজান মাসে তারা যেন ন্যূনতম দামে খাঁটি এবং নির্ভেজাল পণ্য কিনতে পারে। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে, এই প্রত্যাশা বারবার অপূর্ণ থেকে গেছে। রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং মানের অবনতি সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর হতাশা এবং ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিশেষত, নিম্ন ও সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে একটি সুসমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ এই পবিত্র মাসে আর্থিক চাপে না পড়ে। প্রথমত, বাজারের পরিস্থিতি নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ব্যবসায়ীদের ওপর কঠোর নজরদারি চালিয়ে সিন্ডিকেটের অপব্যবহার রোধ এবং জোরপূর্বক দাম বৃদ্ধির প্রচেষ্টা প্রতিহত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি মজুত ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। আমদানি ও সরবরাহ চেন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি উদ্যোগে কম দামে পণ্য সরবরাহের বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে, যেমনÑ ট্রাক সেলের মাধ্যমে ভর্তুকিযুক্ত পণ্য বিক্রি করা। তৃতীয়ত, ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করা উচিত। ব্যবসায়িক নীতিমালা ও মানবসেবার দিকটি তুলে ধরে তাদের ন্যায্য লাভে পণ্য বিক্রি করতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। বিশুদ্ধ পণ্য উৎপাদন ও বিক্রিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহী করতে হবে। কোনো ব্যবসায়ী যদি বাজার ব্যবস্থাপনায় অনৈতিক কাজ করে, তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রমজান মাসে দামে কারসাজি বা সিন্ডিকেট পরিচালনার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে এবং একটি শক্তিশালী বার্তা যাবে যে, সরকার তাদের পাশে আছে। গরিব মানুষের জীপনযাপনকে প্রভাবিত করে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা উচিত। যেমনÑ এবার ভ্যাট, শুল্ক আরোপ করার ফলে বেশকিছু নিত্য পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। কিছু পণ্য থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করার পরেও বাড়তি দাম রয়েই গেছে। নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির অভাবহেতু এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা। সবশেষে, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে ক্রেতারা ন্যায্যমূল্যের বিষয়ে সচেতন থাকেন এবং বাজারের অনিয়মের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানান। এই কার্যকরী উদ্যোগগুলোর সমন্বয়ে রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারেÑ যদিও সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা কঠিন।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা। এ দায়িত্ব পালনে সরকারের উচিত বাজার নিয়ন্ত্রণে একটি সুসংহত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রথমত, বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে একটি সক্রিয় দল গঠন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে আমদানি এবং উৎপাদন ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে হবে। তৃতীয়ত, ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ন্যায্যমূল্য বজায় রাখতে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
রমজান মাসে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দামে কারসাজি বা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে। সর্বোপরি, জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সরকারকে অবশ্যই সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। রমজানের সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা তৈরির একটি বড় সুযোগ। সরকারের কার্যকরী ভূমিকার মাধ্যমে এই আস্থা অর্জন সম্ভব হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের জন্য একটি জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই সময়টিতে জনগণের প্রত্যাশা থাকে যে, সরকার এমন পদক্ষেপ নেবে, যা তাদের ন্যূনতম দামে খাঁটি এবং প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহে সহায়তা করবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নীতিপূর্ণ ব্যবসায়িক নীতি ও সামাজিক মূল্যবোধের কারণে রমজানে পণ্যের দাম সাধারণত স্থিতিশীল থাকে, যেখানে ব্যবসায়ীরা লাভের তুলনায় মানবসেবাকে প্রাধান্য দেন। কিন্তু বাংলাদেশে সেই সংস্কৃতির অভাব রয়েছে। এর ফলে, অনেক ব্যবসায়ী মুনাফার জন্য রমজানের মতো একটি পবিত্র সময়ে পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দেন, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত, বাজার পরিস্থিতি কঠোরভাবে মনিটর করা, সিন্ডিকেটের অপব্যবহার রোধ এবং জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে। একমাত্র তখনই মানুষ সরকারের প্রতি হতাশার পরিবর্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে এবং সরকারের ভূমিকা হবে প্রশংসিত।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

×