ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০ মাঘ ১৪৩১

শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চায় অবহেলা নয়

সাইমা হাসান

প্রকাশিত: ১৯:২২, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চায় অবহেলা নয়

ভাষা কেবল ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়; এটি একটি জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের ধারক। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, যা আমরা রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় জাতি আত্মত্যাগ করেছে। অথচ, আজকের দিনে যেন বাংলা ভাষা ক্রমশ বিকৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। শুদ্ধ বাংলা ভাষার প্রতি উদাসীনতা এবং ইংরেজি শব্দের অপব্যবহার বাংলার সৌন্দর্য এবং স্বকীয়তাকে নষ্ট করছে।

আজকের সমাজে বাংলা ভাষার ব্যবহারিক দুটি প্রধান সমস্যার কথা উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, শুদ্ধ বাংলা বানান এবং উচ্চারণের প্রতি অবহেলা। কথ্য লেখ্য ভাষায় ভুলের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, অনেকেইমন্ত্রিসভা শব্দটিকে ভুলভাবেমন্ত্রীসভা বলেন বাসম্মান শব্দটিসন্মান রূপে উচ্চারণ করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, এমনকি সরকারি নথিপত্রেও ধরনের ভুল বেড়ে চলেছে। এই প্রবণতা প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু হওয়া ভুল শিক্ষার ফল। ভাষার প্রতি দায়িত্বশীলতার অভাব এবং শুদ্ধ বাংলা শেখানোর উদ্যোগের ঘাটতি এর মূল কারণ। দ্বিতীয়ত, আধুনিকতার নামে বাংলায় অতিরিক্ত ইংরেজি শব্দের প্রবেশ। বর্তমানেবাংলিশ নামে এক ধরনের মিশ্র ভাষার ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি কেবল কথোপকথনে সীমাবদ্ধ নয়; গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘তোমার প্রেজেন্টেশনটা ইমপ্রেসিভ,’ কিংবাআমার মুড অফÑ এমন বাক্যগুলো বাংলার শুদ্ধ রূপকে আড়াল করছে।

বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এক্ষেত্রে ইংরেজি শেখা বা ব্যবহার কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, ইংরেজির প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতা। মাতৃভাষার প্রতি এই অবহেলা আমাদের জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিকে দুর্বল করছে। জাপানি জাতির মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্বশীল মনোভাব আমাদের জন্য একটি অনুকরণীয় উদাহরণ। জাপানিরা তাদের ভাষায় বিদেশী শব্দ গ্রহণ করলেও সেগুলোকে নিজেদের নিয়ম মেনে অভিযোজিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইংরেজি শব্দঈড়সঢ়ঁঃবৎ জাপানি ভাষায় হয়েছেコンピュータ (কোম্পিউটা), এবংঈড়ভভবব হয়েছেコーヒー (কোহি) কিন্তু আমরা বাংলায় বিদেশী শব্দকে মানিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে সেগুলোকে সরাসরি ব্যবহার করছি, যা ভাষার শুদ্ধতাকে নষ্ট করছে।

বাংলা ভাষার এই অবক্ষয় রোধে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, প্রাথমিক শিক্ষায় শুদ্ধ বাংলা শেখানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষক এবং অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে শুদ্ধ ভাষার চর্চায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও শিশুদের মধ্যে বাংলা সাহিত্য পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারের প্রতি জোর দিতে হবে। ভুল উচ্চারণ বা ভুল বানানকে প্রচার মাধ্যমে স্বাভাবিক বলে উপস্থাপন করা হলে তা নতুন প্রজন্মকে ভুল শিক্ষা দেয়। এছাড়া, ভাষার শুদ্ধতায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। স্কুল এবং কলেজে ভাষার চর্চা নিয়ে প্রতিযোগিতা, কর্মশালা এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে। বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের সাহিত্যিকদের রচনা, বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একটি বড় উদাহরণ হলো একুশে ফেব্রæয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগকে স্মরণ করি। কিন্তু কেবল দিনটিকে উদযাপন করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে, পেশাগত ক্ষেত্রে এবং সামাজিক মঞ্চে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব রয়েছে। ভাষার বিকৃতি রোধে সচেতন হওয়া, শুদ্ধ উচ্চারণ এবং বানানের চর্চা করা এবং মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভাষার প্রতি অবহেলা করলে আমরা কেবল আমাদের ঐতিহ্যকেই হারাবো না, হারাবো বাঙালি হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয়ের মূল।

আসুন আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে শুদ্ধ বাংলা চর্চা করি। আধুনিকতার অজুহাতে মাতৃভাষার বিকৃতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে, ভাষার সৌন্দর্য এবং ঐতিহ্য রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করি। শুদ্ধ বাংলার চর্চা শুধু ভাষার মর্যাদাই বাড়াবে না, বরং আমাদের জাতীয় গৌরব সংস্কৃতিকে অক্ষুণœ রাখবে।

 

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ

[email protected]

×