আন্দোলন মানব সভ্যতার অগ্রগতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এটি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্য ব্যবহৃত শক্তিশালী মাধ্যম। ইতিহাসে দেখা যায়, যখনই কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠীর অধিকার খর্ব হয়েছে, তখন তারা আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবি আদায় করেছে। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের চরিত্রও পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় আন্দোলন ছিল নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার, কিন্তু বর্তমানে কিছু আন্দোলন উদ্দেশ্যহীন, বিশৃঙ্খল ও সহিংস হয়ে উঠেছে, যা সমাজের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে আন্দোলন কি আসলেই আশীর্বাদ নাকি কখনো কখনো এটি অভিশাপে পরিণত হয়?
আন্দোলন হলো সংগঠিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম। এটি হতে পারে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য কিংবা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য। সাধারণত আন্দোলন তখনই গড়ে ওঠে, যখন জনগণের দাবি বা অধিকার উপেক্ষিত হয় এবং তারা অন্য কোনো বিকল্প না পেয়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ জানায়।
যখন একটি শ্রেণি বা জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চনার শিকার হয়, তখন তারা আন্দোলনে নামে। ভাষার অধিকার, ভোটাধিকার, শ্রম অধিকার ইত্যাদি দাবিতে আন্দোলন করে থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ বা অন্যান্য নীতিগত পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন গড়ে ওঠে। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন হতে পারে।
আন্দোলন সাধারণত কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়Ñ প্রথমে সমস্যা চিহ্নিত করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। এরপর জনসমর্থন ও সংগঠন গড়ে তোলা হয়। আন্দোলন মিছিল, ধর্মঘট, বিক্ষোভ কিংবা অবরোধের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলনের দাবি বাস্তবায়নের জন্য সরকার বা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়।
কল্যাণকর আন্দোলন সেই আন্দোলন, যা গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ এবং দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কিছু আন্দোলন উল্লেখযোগ্যভাবে কল্যাণকর ছিলÑ ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), আইয়ুব বিরোধী অভ্যুস্থান (১৯৬৯) মহান মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১), স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন (১৯৯০), নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (২০১৮), কোটা সংস্কার আন্দোলন (২০২৪) কল্যাণকর আন্দোলনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট এবং জনস্বার্থে হওয়া প্রয়োজন। জনগণের মধ্যে অহিংস আন্দোলন বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। অধিকাংশ মানুষের সমর্থন পাওয়া আন্দোলনের সাফল্য নিশ্চিত করে। আন্দোলনে সফলতার পর তা যদি বাস্তবসম্মত পরিবর্তন আনে, তবে তা কল্যাণকর হয়ে ওঠে।
বর্তমানে আন্দোলনের প্রকৃতি অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। অতীতে আন্দোলন ছিল সংগঠিত এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্যের অধিকারী, কিন্তু বর্তমানে অনেক আন্দোলন অপরিকল্পিত এবং স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। অনেক রাজনৈতিক দল জনগণের প্রকৃত সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরাতে বা সরকারকে অস্থির করতে অহেতুক আন্দোলনের ডাক দেয়। ফলে জনগণ প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং অরাজকতা বৃদ্ধি পায়।
অনেক সময় অল্প বিষয় নিয়েও বিশৃঙ্খল আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ায়। যানবাহন বন্ধ, রাস্তায় আগুন, জনসাধারণের চলাচলে বাধা এসব আন্দোলনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ক্ষতিকর।অনেক আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত সহিংস হয়ে ওঠে। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা, যানবাহনে আগুন দেওয়া, জনসাধারণের ওপর আক্রমণÑ এসব কারণে জনঅসন্তুষ সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় ইস্যুতে দীর্ঘদিন ক্লাস বন্ধ থাকে, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তোলে। বর্তমানে অনেক আন্দোলন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজবের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা প্রকৃত তথ্য ও সমস্যার পরিবর্তে ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। এতে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় এবং অপ্রয়োজনীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
আন্দোলন যখন ন্যায়ের পক্ষে, শান্তিপূর্ণ, জনস্বার্থে এবং সংগঠিত হয়, তখন তা সমাজের জন্য আশীর্বাদ। ইতিহাসের বড় পরিবর্তনগুলো ইতিবাচক আন্দোলনের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। তবে, যখন আন্দোলন রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হয়ে ওঠে, জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে বা সহিংস রূপ নেয়, তখন তা অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।
বর্তমান সময়ে আন্দোলনের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে আমাদের বুঝতে হবে কোন আন্দোলন আমাদের সমাজের জন্য কল্যাণকর এবং কোনটি কেবল বিশৃঙ্খলা বাড়ায়। একটি আন্দোলন যেন সঠিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় এবং জনগণের প্রকৃত স্বার্থ রক্ষা করে, তা নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব। শুধু তখনই আন্দোলন হবে সত্যিকারের আশীর্বাদ, অভিশাপ নয়।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Istiak28060511@gmail