বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি বছরই এক অনিশ্চিত যুদ্ধের মতো। একদিকে কঠিন পাঠ্যসূচি, অন্যদিকে নানা প্রশাসনিক জটিলতা শিক্ষার্থীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। বিশেষ করে সা¤প্রতিক বছরগুলোতে পরীক্ষার তারিখ পেছানো, প্রশ্নপত্র ফাঁসের আতঙ্ক, পাঠ্যসূচির হঠাৎ পরিবর্তন ও মানসিক চাপের মতো নানা সমস্যায় ভুগছে শিক্ষার্থীরা। এই বাস্তবতা কেবল তাদের একাডেমিক অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে না, বরং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলোকেও অনিশ্চিত করে তুলছে।
বাংলাদেশে বোর্ড পরীক্ষাগুলো শিক্ষার্থীদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পরীক্ষাগুলোর ফলের ওপর নির্ভর করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ, ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার পরিকল্পনা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। কিন্তু যখনই পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়, তখন থেকেই শিক্ষার্থীদের মনে একপ্রকার আতঙ্কের সৃষ্টি হয়Ñ পরীক্ষা ঠিক সময়ে হবে তো? কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, নানা কারণে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সময় পেছানো হচ্ছে। কখনো রাজনৈতিক অস্থিরতা, কখনো বন্যা কিংবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কারণ দেখানো হচ্ছে। এসব পরিবর্তনের ফলে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি বাধাগ্রস্ত হয়, মনোযোগ নষ্ট হয় এবং মানসিক চাপ অনেক গুণ বেড়ে যায়। একজন শিক্ষার্থী যখন একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে প্রস্তুতি নিয়ে আসে, তখন পরীক্ষা পেছানো মানে সেই পরিকল্পনাকে আবার নতুনভাবে সাজানো, যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।
শুধু পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তনই নয়, প্রশ্নফাঁসের মতো গুরুতর সমস্যাও শিক্ষার্থীদের জন্য বড় এক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদল অসাধু চক্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন উপায়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে। অনেকে নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সেই প্রশ্ন কিনে পরীক্ষায় ভালো ফল করার চেষ্টা করছে। আর অন্যদিকে যারা কঠোর পরিশ্রম করছে, তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে পরীক্ষার প্রকৃত মূল্যায়ন কতটা নিরপেক্ষভাবে হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এ অবস্থার জন্য শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ তারা পরিশ্রম করেও সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছে না।
এসব চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি আরেকটি বড় সমস্যা হলো, একাডেমিক কোর্স কাঠামোর অসংগতি। পাঠ্যসূচি হঠাৎ পরিবর্তন হওয়া, নতুন বিষয় যুক্ত হওয়া বা কঠিন কিছু অংশ বাদ পড়াÑ এসব পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে গাইড করার মতো শিক্ষক বা ব্যবস্থা নেই। যার ফলে তারা পুরো প্রস্তুতির ব্যাপারে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থী শহরের বাইরের বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের, যেখানে শিক্ষার সুযোগ সীমিত। অনলাইন শিক্ষার সুযোগ থাকলেও সবার জন্য তা সহজলভ্য নয়। ফলে শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হচ্ছে, যা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এসব সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। প্রতিযোগিতার এই যুগে ভালো ফলের জন্য শিক্ষার্থীদের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করা হয়, যা তাদের মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তোলে। পরীক্ষার চাপ, অনিশ্চয়তা, পারিবারিক প্রত্যাশাÑ সব মিলিয়ে অনেক শিক্ষার্থী হতাশায় ভোগে। কিছু ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, আত্মহত্যার মতো চরম পথ বেছে নেয় কিছু শিক্ষার্থী। অথচ এই সমস্যা সমাধানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ও শিক্ষাব্যবস্থার নীতিনির্ধারকদের আরও বাস্তবসম্মত ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, পরীক্ষার সময়সূচি নির্ধারণে আরও স্থিরতা আনতে হবে, যেন শিক্ষার্থীদের অযথা বিভ্রান্ত হতে না হয়। দ্বিতীয়ত, প্রশ্নফাঁসের মতো গুরুতর অপরাধ কঠোরভাবে দমন করতে হবে, যাতে প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন সঠিকভাবে করা যায়। তৃতীয়ত, পাঠ্যসূচির পরিবর্তনগুলো পরিকল্পিতভাবে এবং পর্যাপ্ত সময় নিয়ে করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা যথাযথভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে। সর্বোপরি, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে কাউন্সেলিং সেবা চালু করা জরুরি।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তরুণ প্রজন্মের সঠিক শিক্ষা ও মানসিক সুস্থতার ওপর। এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সুসংগঠিত, নিরপেক্ষ ও চাপমুক্ত পরীক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। শিক্ষার্থীদের যদি ন্যায্য মূল্যায়ন, মানসিক স্বস্তি ও উপযুক্ত পরিবেশ দেওয়া যায়, তাহলে তারা নিজেদের যোগ্যতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটাতে পারবে এবং দেশও লাভবান হবে এক দক্ষ, মেধাবী ও আত্মবিশ্বাসী তরুণ প্রজন্মের মাধ্যমে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ