ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯ মাঘ ১৪৩১

নদী রক্ষায় সোচ্চার হোন

খন্দকার বদিউজ্জামান বুলবুল

প্রকাশিত: ১৯:২৩, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

নদী রক্ষায় সোচ্চার হোন

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীই প্রাণ। অট্টালিকা সমৃদ্ধ বড় বড় শহর গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। ইতিহাসে আমরা যত বিশাল আর সমৃদ্ধ সভ্যতা দেখি না কেন- তাদের সভ্যতার বিস্তার লাভ করেছে নদীকে কেন্দ্র করেই। এক সময় সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে পৌরাণিক কাহিনী, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প, ভৌগোলিক গড়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা এমনকি জীবিকার অনুষঙ্গ গড়ে উঠেছিল নদীকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের উর্বরতা সমৃদ্ধ মাটি তৈরিতে প্রধান কারিগর নদী। বাংলাদেশে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। ছাড়াও শাখা-প্রশাখা মিলিয়ে ৭০০ এর মতো নদ নদী এবং অসংখ্য খাল-বিল বাংলাদেশের বুক চিড়ে নেটওয়ার্কের জালের  মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দেশে কৃষি কাজে যুগ যুগ ধরে নদীর সেবা পেয়ে আসছে জনগণ। কৃষি খেতে সেচ দেওয়া থেকে শুরু করে শিল্প কারখানায় অন্যতম প্রধান সহায়ক হিসেবে পানি অপরিহার্য। যে পানির জোগান দিয়ে থাকে নদী। গর্ভস্থ পানির লেয়ার ধরে রাখতে নদী অদ্বিতীয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মাটির স্বাস্থ্য ধরে রাখতে পানি খুবই কার্যকর। ছাড়াও সামুদ্রিক অনেক মাছ প্রজননের সময় নদীতে এসে ডিম পাড়ে।

আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলো আজ মুমূর্ষু অবস্থায়। দখল-দূষণে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে এক সময়ের খরস্রোতা উপকারী নদীগুলো। ইদানীং দেখা যাচ্ছে অসাধু মিদস্যুদের নদী দখলের অবাধ প্রতিযোগিতায় ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনে নদীগুলো নাব্য হারিয়ে আজ মৃতপ্রায়। আন্তঃদেশীয় নদীগুলোর ওপর বাঁধ দেওয়ার ফলে পানির প্রবাহে তারতম্য সৃষ্টি হওয়ায় নদীগুলো হারাচ্ছে স্বাভাবিক প্রবাহ এবং শুকনো মৌসুমে পানি কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। ছাড়াও ট্যানারি, কল-কারখানার দূষিত বিষাক্ত বর্জ্য অবাধে নদীতে ফেলা, গৃহস্থালি বর্জ্য, কৃষিতে ব্যবহার্য রাসায়নিক সার বিষ যা বৃষ্টির পানির সঙ্গে নদীতে মিশে নদী দূষণে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসে সহায়তা করছে। হাসপাতাল-ক্লিনিকের বর্জ্য জাহাজের তেল এবং শহরের অপচনশীল কঠিন আবর্জনা নদী দূষণে সমানতালে দায়ী। পলিথিন বা প্লাস্টিক মাটিতে বা পানিতে মিশে না। প্লাস্টিক মারাত্মকভাবে নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্য দায়ী। অপরিকল্পিতভাবে নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন স্থাপনা যা নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। নদী দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব ভয়াবহ। নদী দূষণের ফলে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য মানব স্বাস্থ্যের জন্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। নদী দূষণের ফলে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধিসহ মানব স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি করে। নদী দূষণের ফলে পরিবেশ জীববৈচিত্র্য বিপর্যয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জন্য প্রাণঘাতী ক্যান্সার রোগের অনুক পরিবেশ সৃষ্টি করে। ছাড়াও অ্যাজমা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, চর্ম ফুসফুসের রোগসহ পানিবাহিত বিভিন্ন জটিল কঠিন রোগের সৃষ্টি করে। মানুষের নির্মমতায় যৌবন হারিয়ে মরা খালে পরিণত হচ্ছে একসময়ে প্রবাহমান স্রোতস্বিনী। বিরতিহীনভাবে নদী দখল দূষণের ফলে নদী হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক প্রবাহ। দূষণের ফলে তীব্র দুর্গন্ধে নাজেহাল হচ্ছে মানুষজন। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের সোনালি শৈশব। সাঁতার কাটার জায়গা না পেয়ে সাঁতার শেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অনেক শিশু। যা অনেক ক্ষেত্রে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর অঙ্কটা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

দূষণের করাল গ্রাস থেকে নদীগুলোর জীবনীশক্তি ফিরিয়ে আনতে রক্ষা করতে নদীর ওপর চালানো অত্যাচারের স্টিমরোলার বন্ধ করতে হবে। যত্রতত্র বাঁধ, কালভার্ট ব্রিজ তৈরিতে যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নদী দূষণ রোধে নদীর পানিতে বর্জ্য ফেলা বা নৌযান নির্গত বর্জ্য নিক্ষেপে যথা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। নৌযান চলাচলের জন্য বিকল্প জ্বালানির কথা চিন্তা করা যেতে পারে। শিল্প কল-কারখানায় বর্জ্য নদীতে না ফেলে তা পরিশোধনের ব্যবস্থা বা নিরাপদভাবে বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্লাস্টিক জাতীয় কঠিন বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করা যেতে পারে। ছাড়াও পলিথিন বা প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যের বিকল্প ভাবা যেতে পারে। ট্যানারি থেকে নির্গত বর্জ্য নদীতে ফেলা থেকে যথা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। কৃষি কাজে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার কীটনাশক প্রয়োগ থেকে সরে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে জৈব ভার্মিকম্পোস্ট সার ব্যবহার করা যেতে পারে। মেডিক্যাল বর্জ্য যত্রতত্র বিশেষ করে নদীতে ফেলা থেকে যথা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। নদীর দুই পাড় রক্ষায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। দখলকৃত নদী দখলমুক্ত করে সিমানা নির্ধারণ করতে হবে। নদীর পানির গুণগত মান ভালো রাখতে পারলে নদী তীরবর্তী বাসস্থানের উন্নতি ঘটানো সম্ভব। ছাড়া নদী দখল মুক্ত করতে আমাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার বড্ড বেশি প্রয়োজন। জাগ্রত সচেতন নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা সরকারের সুদৃষ্টি এবং আইনের অনুশাসন মৃতপ্রায় নদীগুলোকে রক্ষায় করতে কার্যকরী হতে পারে।

 

×