আরও একটি বছরকে পেছনে ফেলে শুরু হলো নতুন বছর। ভাবতে অবাক লাগে, সময়ের ঝড়ো হাওয়ায় চোখের নিমেষে ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো কিভাবে উল্টে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটরা বড় হচ্ছে আর বড়রা ছোট হচ্ছে। দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর, বছর গড়িয়ে দশক। মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হলো না! সময়ের আবর্তে আমার চিন্তা-চেতনা, জীবন-যাপনে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। চেহারা বদলে গেছে। চঞ্চলতা হারিয়ে গেছে। কারণে-অকারণে হাসতেও ভুলে গেছি। চুলে পাক ধরেছে। মুখে বয়সের বলিরেখা পড়েছে। ব্যক্তিত্ব শাণিত হয়েছে বটে, কিন্তু হারিয়ে গেছে ঘুম। লুকানোর কিছু নেই। আমি যা আমি তাই।
সময় বড্ড স্বার্থপর। চলে যাওয়ার পথে হৃদয়ে আঁচড় কেটে যায়। কেড়ে নেয় আবেগমথিত ভালোবাসাগুলো। যে মানুষটি সবচেয়ে আপন ছিল, সেও কেমন যেন অপরিচিত হয়ে গেছে। যে ভাবতে শিখিয়েছিল আমি তার সবচেয়ে আপনজন, সময়ের আবর্তনে সে মানুষটিও কেমন বদলে গেছে। হয়তো এটাই রীতি।
মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কগুলো আসলেই মধুর। চেনা নেই, জানা নেই চলার পথে পরিচয়। তারপরও আমরা সম্পর্কে জড়িয়ে যাই। বেলা-অবেলায় কেটে যায় জীবন। এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে একদিন সবাইকে বিদায় নিতে হবে। কেউ একজন চলে গেলে কারোরই কিছু যাবে আসবে না। কারণ, সব মৃত্যু মানুষকে সমানভাবে কাঁদায় না বা ভাবায় না। সব মৃত্যুর ক্ষতিও সমান নয় বিশ্বের কাছে। কিন্তু তারপরও এমন কিছু স্মৃতি থাকে, যা একান্ত সংগোপনে নাড়া দিয়ে যায়। নিবিড় বেদনায় মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। গভীর রাতে আন্দোলিত করে হৃদয়কে।
জীবন বড়ই অনিশ্চিত, ক্ষণস্থায়ী। এটা জেনেও একে ঘিরে আমাদের কতই না আয়োজন। ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত যা কিছুই করি, সবই তো এই জীবনের জন্য। একবার ভাবুন তো এই জীবনটাকে ভালোভাবে উপলব্ধি বা বুঝে ওঠার আগেই যদি পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়, তাহলে কতই না আফসোস থাকবে? মনে করুন, ভয়ংকর এক ভূমিকম্পে পৃথিবীর সব বাড়ি ঘর ধূলিসাৎ হয়ে গেল কিংবা প্রবল এক সুনামিতে পুরো পৃথিবী চলে গেল জলের তলায় কিংবা পৃথিবীতে ফিরে এলো তুষার যুগ। পুরো পৃথিবী ঢাকা পড়ে গেল বরফের নিচে। সেই ভয়ংকর মুহূর্তে মানুষ কী বাঁচবে? তখন কী হবে এই বিশ্ব সভ্যতার?
প্রতিদিন আয়নায় মুখ দেখি। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় নিজের ছবি বন্দি করি। সিসিটিভি ক্যামেরার ভিতর বসবাস করি। তারপরও নিজেকে হারিয়ে ফেলি। আসলে জীবনটা বড়ই অদ্ভুত। যা কখনো ভাবিনি, যা কখনো প্রত্যাশা করিনি তাই ঘটেছে। সামান্য মানুষ, তা সত্ত্বেও এ ক্ষুদ্র জীবনে এত ভালোবাসা পাব বুঝিনি। অনেক পেয়েছি, বিনিময়ে কিছুই দিতে পারিনি। হয়তো পারবও না। শূন্য হাতেই চলে যেতে হবে। আকস্মিক এসেছি, আকস্মিকই চলে যাব। জীবন বড়ই রহস্যময়। মানুষের ভাবনাগুলো আরও রহস্যময়।
জীবনে এতটা অখণ্ড অবসর আসবে ভাবতেও পারিনি। পড়াশোনাই যেন হয়ে উঠেছে জীবনসঙ্গী। যতই পড়ি ততই মনে হয় আমার জানার পরিধি কতই না সীমাবদ্ধ। কতই না বোকা, নির্বোধ। পড়তে পড়তে মনে হয় আমি যেন মাত্রই হামাগুড়ি শেষে উঠে দাঁড়িয়েছি। হাঁটা শিখেছি। শীঘ্রই হয়তো দৌড়াব। তারপর হয়তো উড়ব। এরপর আর থামব না।
অন্যদের থেকে আমি কিছুটা পিছিয়ে পড়া মানুষ। তবে খুব আবেগি ও কল্পনাবিলাসী। স্বপ্ন তৈরি হয় কল্পনা থেকে। আর অনুভব তৈরি হয় অনুভূতি থেকে। যখন যা অনুভব করি তা লিখে ফেলি। লেখালেখির সামান্য চর্চা আছে বলেই কিছুটা সজীব আছি। হতাশা ততটা কাছে ঘেষতে পারে না। নানা অঘটন থেকে নিজেকে দূরে রাখার একটা ক্ষুদ্র প্রয়াস হলো লেখালেখির মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। শুনেছি, যারা লেখালেখি করেন দুঃখ-কষ্ট-হতাশা তাদের অত সহজে কাবু করতে পারে না।
এই অখণ্ড অবসরে লেখালেখি করে সময় কাটাই বটে তবে এটাও জানি যে, একজন সত্যিকারের লেখক হতে গেলে যেসব গুণাবলি থাকা দরকার তা আমার নেই। যখন কোনো ভালো একটা লেখা পড়ি তখন মনে হয় আমি কত তুচ্ছ, কত সাধারণ। তখন নিজেই নিজের কাছে লজ্জা পাই। তবে এটাও ঠিক যে, যা কিছু লেখি, যা কিছু করি, নিজের আনন্দের জন্য করি। অন্যকে ইমপ্রেস করার মতো কোনো যোগ্যতা আমার নেই। কবি বলেছেন, ‘সব ফুল কি আর ফুটে? কিছু কিছু ফুল ফোটার আগেই ঝরে যায়’। মানুষের জীবন সব সময় সুখের হয় না, আনন্দের হয় না, থাকে অনেক ব্যথা, ব্যর্থতা ও না পাওয়ার বেদনা। এসব মেনে নিয়ে বেঁচে থাকাটাই জীবনের সার্থকতা।
লেখক : চেয়ারপারসন, ব্যুরো বাংলাদেশ