ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমাদের ভাষা আন্দোলনের কথা মনে পড়ে। কারণ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূলভিত্তি। যে কারণে আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। আন্দোলন-নির্যাতন, সংগ্রাম এবং রক্তের বিনিময়ে ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা বাংলা উচ্চশিক্ষায় অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত, যা খুবই দুঃখজনক। যেমনÑ স্নাতক লেভেলে অনেক অনুষদে প্রায় সকল কোর্সে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হয়।
একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা তখনই সংকটে পড়ে, যখন দেশের শিক্ষা, আইন ও দাপ্তরিক কাজে বাংলার যথাযথ ব্যবহার হয় না। অনেক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসে চিঠিপত্রে নানা রকমের বানান ভুল থাকে। কিছু ভুল কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কেউ কেউ বলে থাকেন, আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি ছাড়া উচ্চশিক্ষার প্রসার হওয়া কঠিন। এ কথা সর্বক্ষেত্রে সত্য নয়। তাই যদি হয়, চীন, জাপান তাহলে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র হতো না।
চীন তাদের নিজস্ব ভাষাকে সব ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিচ্ছে। জাপান ইংরেজি ভাষাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। একটি দেশের উন্নয়নে মাতৃভাষার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। মাতৃভাষা যত বেশি শক্তিশালী হবে, তত বেশি উন্নত হবে দেশ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনও সার্থক হবে।
জাতীয় জীবনে বাংলা ভাষা কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারছে? বাংলা ভাষার কতটুকু যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে? তা নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। স্বাধীনতার পরে জাতীয় সংবিধানে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তৈরি হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষার অপার সম্ভাবনা। কিন্তু বাস্তবে কি তা কার্যকর হয়েছে? রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতি পাওয়ার পর সরকারি অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা প্রয়োগ শুরু।
তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নানা সময়ে নানা কারণে থমকে যায় বাংলা ভাষার ব্যবহার। পরিবর্তে প্রয়োগ হয় ইংরেজি। যা বাংলাভাষার ক্ষতি করেছে। এখনো দেখা যায় কেউ ভুল ইংরেজি বললেও অনেক মানুষ মনে করে যে সে বড় পণ্ডিত। আসলে তা নয়। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন শতভাগ কার্যকর করতে হবে। যেমনÑ বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে দেখা যায় ব্যানারে ইংরেজি শব্দ ওরিয়েন্টেশন লেখে অনেকে। যা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এসব বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত। শ্রেণিকক্ষে দেখা যায়, ইংরেজি ভাষায় লেকচার দিলে অনেক শিক্ষার্থী বুঝতে পারে না। তখন কিন্তু বাংলা ভাষায় বোঝাতে হয়। কারণ, মাতৃভাষার মাধ্যমে যে কোনো ভাব সবচেয়ে বেশি অনুধাবন করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ।’ অর্থাৎ শিশুরা মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে যেভাবে সম্পূর্ণ তৃপ্তি লাভ করে এবং ক্ষুধা নিবারণ করে, তেমনি মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ তৃপ্তি পেয়ে থাকে। যে কোনো কঠিন বিষয় মাতৃভাষার মাধ্যমে সহজেই বোধগম্য হয়। যা অন্য কোনো ভাষার মাধ্যমে সম্ভব নয়।
বাণিজ্য অনুষদের সকল বিষয় পড়ানো হয় ইংরেজি মাধ্যমে। তবে দুটি কোর্স বাংলা মাধ্যমে পড়া যায়। অন্য সব কোর্সের বই বাংলা মাধ্যমে পাওয়া যায় না। কিছু কিছু বই বাজারে পাওয়া যায়, যা বাংলা ভাষায় রচিত। কিন্তু মান নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। যেমনÑ কোনো একটি বিষয়ের একটি পয়েন্ট ভেঙে তিনটি বা তারও বেশি সাব পয়েন্ট লেখা হয়েছে, যা শুধু একটি সাব পয়েন্টে বোঝানো সম্ভব।
সেজন্য হয়তো অনেক শিক্ষক বাংলা মিডিয়ামের বই টেক্সট বই হিসেবে ক্লাসে ব্যবহার করেন না। কেউ কেউ মনে করেন যে, কোনো শিক্ষক বাংলা মিডিয়ামের বই শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পড়াচ্ছেন। মানে তিনি ইংরেজিতে ভালো পড়াতে পারেন না বলে মনে করা হয়। যা হোক, এ ক্ষেত্রে যদি বাংলা মিডিয়ামে মানসম্মত বই পাওয়া যেত, তাহলে অনেক কাজে আসত। সেজন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যাতে যারা নামি বা গুণী শিক্ষক সমাজে আছেন, তারা যেন অন্য ভাষায় যে ভালো মানের বই আছে, সেগুলো বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। সেক্ষেত্রে যদি প্রণোদনা দেওয়া হতো, তাহলেই শিক্ষার্থীদের অনেক উপকারে আসত।
১০ বছর আগে উচ্চশিক্ষা স্তরের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক অনুবাদের জন্য একটি প্রকল্প ছিল। প্রকল্পটি পাঁচ বছর চলার পর মেয়াদ শেষ হলে সেটা আর চালু করা যায়নি। কারণ, অর্থের সংকট। তাই নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক বা গবেষক বিদেশী ভাষায় লিখিত বই অনুবাদ করতে পারেন। মাতৃভাষার ব্যবহারে যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার ব্যবহার দিন দিন কমে যাচ্ছে। তবে উন্নত দেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া বাধ্যতামূলক। আমরা কেন পারছি না? সবক্ষেত্রে যদি বাধ্যতামূলক বাংলা ভাষার ব্যবহার হতো, তাহলে প্রশ্নপত্র এবং বিজ্ঞপ্তি প্রচারে বানান ভুল হতো না। এখনো দেখা যায়, অনেকে যুক্তবর্ণের সঠিক ব্যবহার জানে না। কারণ, যুক্তবর্ণের মধ্যে কি কি অক্ষর আছে তা বলতে বা লিখতে পারে না। তাই আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সব ধরনের শিক্ষায় মাতৃভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক। যেমনÑ ফ্রান্সে ফরাসি ভাষা, চীনে মান্দারিন ভাষা, রাশিয়ায় রুশ ভাষায় শিক্ষা দেওয়া বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চস্তরে কিছু কোর্স বাংলায় শিক্ষা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা উচিত। সেজন্য অনুষদ অনুযায়ী বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া খুব জরুরি। তিনি ওই অনুষদভুক্ত সকল বিভাগে বাংলা কোর্স পড়াবেন। যাতে শিক্ষার্থীরা বাংলাভাষার সঠিক প্রয়োগ শিখতে পারে। যা তাদের জব মার্কেটেও কাজে আসবে।
পৃথিবীতে সকল জাতি তাদের বুনিয়াদি শিক্ষায় মাতৃভাষা ব্যবহার করছে। আমরা স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও মাতৃভাষায় বুনিয়াদি শিক্ষা দিতে পারছি না। যা খুবই দুঃখজনক। বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা এ বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। সর্বজনীন শিক্ষা চালু করতে হলে স্কুল থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত শতভাগ মাতৃভাষায় শিক্ষার মাধ্যম করা জরুরি। কেউ কেউ বাংলা ভাষায় সর্বজনীন শিক্ষা চালু হোক এটা চায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বুনিয়াদি শিক্ষায় শতভাগ বাংলা ভাষার প্রচলন করুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ