উৎসব আনন্দে ভরপুর হলো বাঙালির সাধারণ জীবনযাপন। বোধকরি সে কারণেই বলা হয় বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এ সকল পার্বণের মধ্যে যেমন আছে নানা প্রকার লোকাচার, মেলা, উৎসব, তেমনি আছে বিভিন্ন রকমের পূজা। সনাতনীরা একদিকে যেমন ধনসম্পত্তির দেবীরূপে লক্ষ্মীকে আরাধনা করে থাকে, তেমনি বিদ্যা এবং জ্ঞানের দেবীরূপে আরাধনা করে থাকে দেবী সরস্বতীর। সনাতন দেবদেবীর মধ্যে দেবী সরস্বতী খুবই জনপ্রিয়। সরস্বতী বিদ্যার দেবী। যার ফলে ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষ সকলেই দেবী সরস্বতীর আরাধনা করেন। অবশ্য দেবী সরস্বতী শুধুই বিদ্যার দেবী নন, তিনি সংগীত ও ললিতকলারও দেবী। দেবীর পূজা কেবল বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষে সীমাবদ্ধ নয়, বহির্বিশ্বেও দেবীর পূজার প্রচলন আছে। হিন্দুদের কাছে দুর্গার পরেই সরস্বতীর অবস্থান।
আজ সরস্বতী পূজা, বাণী অর্চনার আরাধ্য দিন। শুক্লা পঞ্চমীতে শ্বেতশুভ্র কল্যাণময়ী বিদ্যাদেবীর আবাহন হবে। মা সরস্বতী জ্ঞানদায়িনী, বিদ্যাদায়িনী এবং শ্বেতশুভ্র বসনা। তাঁর এক হাতে বীণা অন্য হাতে বেদপুস্তক। অর্থাৎ বীণাপাণিতে যার তিনি বীণাপাণি- সরস্বতী। আর এ থেকেই বাণী অর্চনার প্রচলন। অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করতে কল্যাণময়ী দেবীর পাদপদ্মে প্রণতি জানাবেন পুণ্যার্থীরা। প্রতিবছর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে শ্বেতশুভ্র কল্যাণময়ী বিদ্যা দেবীর আবাহন করা হয়। ঢাকা-ঢোল-কাঁসর আর শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন পূজামণ্ডপ। সরস্বতী বিদ্যার ও ললিতকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবেও পূজিত হন। ঐশ্বর্যদায়িনী, বুদ্ধিদায়িনী, জ্ঞানদায়িনী, সিদ্ধিদায়িনী, মোক্ষদায়িনী এবং শক্তির আধার হিসেবে আরাধনা করা হয় সরস্বতী দেবীর।
সরস্বতী হলেন জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যার দেবী। সরস্বতী দেবীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে সরস্বতী পূজা উৎসব আকারে পালিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সোনার তরী কাব্যগ্রন্থেও পুরস্কার কবিতায় আবেগ ঘনভাবে সরস্বতীর বন্দনা করেছেন। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয়। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্তপঞ্চমী নামেও পরিচিত। উত্তরভারত, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, নেপাল ও বাংলাদেশে সরস্বতী পূজা বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে পালিত হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন অতি প্রত্যুষে বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, ছাত্র-ছাত্রীদের গৃহ ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণ ভোজন ও পিতৃতর্পণের প্রথাও প্রচলিত। পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব, সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী। বৃহস্পতি হচ্ছে জ্ঞানের দেবতা। বৃহস্পতিপত্নী সরস্বতী ও জ্ঞানের দেবী হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরস্বতী কেবল জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার দেবীতে পর্যবসিত হলেন। পণ্ডিতরা অনেকেই মনে করেন যে, সরস্বতী প্রথমে নদী, পরে দেবী হয়েছেন। প্রতিমাকল্পে দেবী সরস্বতীকে শ্বেতবর্ণা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, মুক্তার হারে ভূষিতা, পদ্মলোচনা ও বীণা পুস্তক ধারিণী এক দিব্যনারী মূর্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। দেবীর বাহন রাজহাঁস। রাজহাঁস জল ও দুগ্ধের পার্থক্য করতে পারে। জল ও দুধের মিশ্রণ থেকে হাঁস কেবল দুগ্ধ ও ক্ষীরটুকুই গ্রহণ করে। জ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রেও তাই। হাঁস জলে বিচরণ করে, কিন্তু তার দেহে জল লাগে না। মহাবিদ্যার বেলাও একই কথা। ক্ষীরটুকু রয়ে যায় অনুশীলনকারীর মধ্যে। প্রাচীনকালেও সাধকরা সরস্বতীসদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির ওপর তাল পাতা ও দোয়াত কলম রেখে পূজা করা হতো। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্ররা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এই পূজার বিসর্জন দেখতে আসত। আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।
শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা হয়। সরস্বতী পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই করা হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যেমনÑ অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ। পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাচার অনুসারে, ছাত্রছাত্রীদের পূজার আগে কুল খাওয়া নিষেধ। পূজার দিন পড়ালেখাও ছাত্রছাত্রীদের করা লাগে না বলে প্রচলিত আছে। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, দোয়াত-কলম, পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করা হয়। এইদিন ছোটোদের হাতে খড়ি দিয়ে শুরু হয় পাঠ্যজীবন। পূজান্তে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের দল বেঁধে পুষ্পাঞ্জলি দিতে দেখা যায়। পূজার পরদিন পুনরায় পূজার পর চিড়ে ও দই মিশ্রিত করে দধি কর্মা নিবেদন করা হয়। এরপর পূজা সমাপ্ত হয়। সন্ধ্যায় দেওয়া হয় প্রতিমা বিসর্জন।
লেখক : কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়