একটা সময় ছিল বাস-ট্রেনে চড়ে কোথাও গেলে পাশের সিটে বসা লোকটির সঙ্গে আলাপ হতো। কুশল বিনিময়ের পর বাড়ি, গন্তব্য, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি নিয়ে হতো পারস্পরিক খোঁজখবর। এভাবে পরিচয় হতো অনেক লোকের সঙ্গে। অনেকের সঙ্গে হয়ে যেত বন্ধুত্ব। শুধু বাস-ট্রেন নয়, সামাজিক অনুষ্ঠান, বেড়াতে যাওয়া, এমনকি হাট-বাজারের আলোচনায়ও পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়ে যেত। সময় পাল্টে গেছে। বাস-ট্রেনের সিটে বসে সবাই মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাশে কে বসেছে সেদিকে খেয়াল পর্যন্ত কেউ করে না। সামাজিক মিলনমেলায়ও মানুষ যেন বাধ্য হয়ে অংশ নিচ্ছেন, অনেকটা যান্ত্রিকভাবে। যান্ত্রিক যুগে পরিবর্তনের হাওয়ায় বদলে যাচ্ছে মানুষের আচরণ। আলগা হয়ে যাচ্ছে সামাজিক বন্ধন। দীর্ঘদিনের প্রচলিত নিয়মকানুনে আসছে পরিবর্তন। সামাজিকতা পরিণত হচ্ছে আনুষ্ঠানিকতায়। আন্তরিকতার স্থান দখল করছে লৌকিকতা। তৈরি হচ্ছে না নতুন সম্পর্ক। পুরানো সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। মানুষ হয়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিক। প্রাণখোলা উচ্ছলতার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কৃত্রিমতা। প্রয়োজনের বাইরে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে মানুষের কোমল অনুভূতিগুলো। পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে পোশাক-আশাক এবং খাদ্যাভ্যাসও। পরিবর্তন আসছে মানুষের রুচিতেও। প্রযুক্তি কি আমাদের সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে?
পশ্চিমা সমাজে এই ধারা শুরু হয়েছে অনেক আগে। আনুষ্ঠানিকতার বাইরে ব্যক্তিগত সম্পর্কের তেমন মূল্য নেই সেখানে। মানুষ হয়ে গেছে অনেকটা যন্ত্রের মতো। আত্মীয়তার বন্ধনে জোর নেই। কৃত্রিমতা সীমারেখা টেনে দিয়েছে নির্মল বন্ধুত্বের মাঝখানে। কেউ কারও খোঁজ রাখে না। সম্পর্কের বিষয় নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায় না। বাঙালি সমাজে সামাজিকতা ও আন্তরিকতা বজায় ছিল দীর্ঘদিন। কারণে-অকারণে মানুষে মানুষে সম্পর্ক তৈরি হতো। ব্যক্তিগত আচার অনুষ্ঠানও পরিণত হতো সামাজিক অনুষ্ঠানে। এখন বাঙালি সমাজও দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে সম্পর্কের সমীকরণ। আগের সামাজিকতা ধীরে ধীরে দুর্লভ হয়ে উঠছে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, পারিবারিক অনুষ্ঠানে দাওয়াতের বিষয়টি ছিল সামাজিকতার একটি অংশ। বিয়ে, জন্মদিন, সন্তানের আকিকা, মুসলমানি, বিয়েবার্ষিকী ইত্যাদি পারিবারিক অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক দাওয়াত দেওয়ার রীতি প্রচলন ছিল। কার্ড ছাপিয়ে কিংবা মৌখিক দাওয়াত দেওয়ার জন্য সবার বাড়ি যেতে হতো। আসা-যাওয়ার মাধ্যমে জোরদার হতো সম্পর্কের সেতুবন্ধ। সশরীরে দাওয়াত না দিতে পারলে অনেকে অনুষ্ঠানে যোগদানই করতেন না। এখন দিন পাল্টে গেছে। প্রথমে টেলিফোন এবং পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সশরীরে যাতায়াতের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে দিয়েছে। পারিবারিক আয়োজনে কারও মাধ্যমে কার্ড পাঠিয়ে দিয়ে ফোন করলেই দায়িত্ব শেষ। এখন আবার কার্ড ছাপানোর ঝক্কিও উঠে যাচ্ছে। গ্রাফিকসের মাধ্যমে কার্ড বানিয়ে তা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে যোগাযোগ মাধ্যম মেসেঞ্জার কিংবা হোয়াটসএ্যাপে। অনেকে মোবাইল ফোনে খুদে বার্তায় দায়িত্ব শেষ করছেন। শিথিল সম্পর্কের কারণে অনুষ্ঠানগুলোতেও প্রাণ থাকছে না। অনুষ্ঠানে দীর্ঘ আড্ডা কিংবা গল্পগুজব হচ্ছে না আগের মতো। খাওয়া-দাওয়ার আনুষ্ঠানিতা শেষ করেই বিদায় নিচ্ছেন সবাই।
নাগরিক জীবনের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত ছিল বরাবর। এক বাড়ির অনুষ্ঠান গোটা পাড়া বা সমাজের সম্মিলিত অনুষ্ঠান হয়ে যেত কোনো ঘোষণা ছাড়াই। কারও বিপদে সমাজের সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ত। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিত সবাই মিলে। বিকেলে খেলার মাঠ কিংবা হাটবাজারে সম্মিলিত হতো বয়স ভেদে সকল মানুষ। চায়ের আড্ডায় আলোচনা হতো সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে। ছোটরা মাঠে মিলিত হতো খেলাধুলার জন্য। নগরিক জীবনে মানুষের ব্যস্ততা ছিল বেশি। এর মধ্যেও আনুষ্ঠানিকতায় পাড়া-মহল্লার বন্ধন চোখে পড়েছে সব সময়। এখন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। কারও খবর কেউ রাখে না। অবসর সময় কাটে টিভির সামনে কিংবা মোবাইল ফোনে।
সমাজের মৌলিক ভিত্তি হলো পরিবার। এখান থেকেই শিশুরা পায় ভবিষ্যৎ জীবনের পথনির্দেশনা। মানুষের প্রথম বিদ্যাপীঠ বলা হয় পরিবারকে। আদিম যুগ থেকে মানবসভ্যতার মৌলিক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পরিবার। প্রতিটি সদস্যের মধ্যে সৌহার্দ্য-ভালোবাসার বিশ্বস্ত সেতুবন্ধ হচ্ছে পরিবারের বৈশিষ্ট্য। মানুষ সামাজিক জীব। অস্তিত্বের প্রয়োজনে আদিম যুগে মানুষের মধ্যে সংঘবদ্ধভাবে বাস করার প্রবণতা শুরু হয়। সৃষ্টি হয় পারিবারিক বন্ধন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের জোয়ারে পারিবারিক বন্ধন এখন ক্ষয়িষ্ণু। ঠুনকো কারণে ভেঙে যাচ্ছে পরিবার। মাঝে-মধ্যে হয়ে উঠছে রণক্ষেত্র। বন্ধন আলগা হয়ে যাওয়ায় বাড়ছে পারিবারিক অস্থিরতা ও সহিংসতা। এর প্রভাবে সংক্রমিত হচ্ছে সমাজ এবং রাষ্ট্র। এক সময় একান্নবর্তী পরিবার ছিল সমাজের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। এখন বিকাশ হচ্ছে ফ্ল্যাটভিত্তিক পরিবারের ধারণা। স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের স্থান সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে পরিবারের। কখনো কখনো অবহেলার শিকার হচ্ছেন বাবা-মা। তাদের বাস করতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। কর্মজীবী বাবা-মায়ের সন্তানদের স্থান হচ্ছে চাইল্ডকেয়ার সেন্টারে। একান্নবর্তী পরিবারের ধারণায় এগুলো কল্পনাও করা যেত না। পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা প্রভাব ফেলছে সামাজিক সম্পর্কে। দূরত্ব তৈরি হচ্ছে এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারের, এক সমাজ থেকে আরেক সমাজের। সমাজবিজ্ঞানীরা এটিকে অবক্ষয় বলছেন না। তাদের মতে, এটি অগ্রসর সমাজের অনিবার্য পরিণতি।
পরিবর্তন শুধু পরিবার বা সমাজে নয়, পরিবর্তন আসছে সামাজিক অনুষ্ঠান, বিনোদন এবং খাদ্যাভ্যাসেও। গ্রামে কৃষকরা পান্তা খেয়ে ছুটে যেতেন মাঠে। শীতের পিঠা পায়েস, তাল-খেজুরের রস ছিল ঐতিহ্যময় খাদ্যের অনুষঙ্গ। বাঙালিদের প্রধান খাবার ছিল ডাল-ভাত এবং পরে ভাত-মাছ। ঘি দিয়ে গরম ভাত খাওয়ার কদর ছিল প্রাচীনকাল থেকে। দুধে রান্না করা চালের পায়েস বাঙালির ঐতিহ্য। নিয়মিত খাদ্য তালিকায় ছিল ভাত, মাছ, শাক, সবজি। অতিথি আপ্যায়নে খাদ্য তালিকায় ছিল মাংস-ডিম, ঘরে পাতা দই, ছানার তৈরি মিষ্টি। খাবার শেষে ঠোঁট লাল করা পান। বিকেলের নাশতা ছিল চিড়া-মুড়ি, খই-নাড়ু নানা জাতের পিঠা-পুলি। আম-কাঁঠালের মৌসুমে জামাইকে দাওয়াত খাওয়ানো ছিল সমাজের রেওয়াজ। বাঙালির খাদ্য তালিকায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে। ধনীদের পাতে ভাতের পরিবর্তে এসেছে রুটি, স্যান্ডউইচ, কাটলেট। ঘি দিয়ে গরম ভাতের কথা কেউ চিন্তাও করে না। সুলভ প্রাপ্যতায় মাছের পাশাপাশি নিয়মিত হচ্ছে মুরগির মাংস। শীতে পিঠা-পুলির আয়োজন হলেও তাল-খেজুরের রস বিলুপ্তপ্রায়। ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেনি পায়েস। নাশতার তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নানা জাতের চা-বিস্কুট, দোকানের মিষ্টি, চানাচুর, নুডলস, সফট ড্রিঙ্কস ইত্যাদি। আম-দুধের সেই স্বাদ নতুন প্রজন্ম উপভোগ করছে না। পোশাকেও লেগেছে পবির্তনের হাওয়া। বাঙালি নারীদের প্রিয় এবং অনিবার্য পোশাক ছিল শাড়ি। মেয়েদের লম্বা চুলের পেছনে বড় খোঁপা, কপালে টিপ, দুই হাত ভর্তি কাচের চুড়ি, নাকে নথ এবং পায়ে নূপুর ছিল বাঙালি নারীদের সাজগোজের অনুষঙ্গ। ছেলেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ছিল পাঞ্জাবি-পাজামা, শার্ট-প্যান্ট। ঘুমানোর একমাত্র পোশাক ছিল লুঙ্গি-গেঞ্জি। সময়ের ব্যবধানে মেয়েদের শাড়ির জায়গা করে নিয়েছে সালোয়ার-কামিজ, টপস-স্কার্ট, লেহেঙ্গা, আরও কত কি। পুরুষরা এখন পাঞ্জাবি পরে সীমিত কিছু আনুষ্ঠানিকতায়। শার্ট-প্যান্ট, গেঞ্জি, স্যুট এখন আধুনিক পোশাক। ঘুমের জন্য লুঙ্গির জায়গায় স্থান পেয়েছে ট্রাউজার বা স্লিপিংস্যুট।
পরিবর্তিত সমাজে পাল্টে গেছে খেলাধুলা ও বিনোদনের ধরন। হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন খেলাগুলো। তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে নতুন নতুন খেলা। আমাদের সমাজে প্রাচীন খেলা ছিল ছেলেদের হা-ডু-ডু বা কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা, ষাঁড়ের লড়াই, বলি খেলা, গোল্লাছুট, মুরগির লড়াই, নৌকাবাইচ, ঘুড়ি ওড়ানো, মার্বেল, কানামাছি, ডাংগুলি, লাঠি খেলা, লাটিম ঘুরানো, ষোলঘুঁটি। মেয়েরা খেলত বউচি, টোপাভাতি, কুতকুত, নন্দাই, ফুট টোকা, ওপেন্টি বায়োস্কোপ ইত্যাদি। নতুন প্রজন্ম এর অধিকাংশ খেলার নামই শোনেনি। এসব খেলার জায়গায় মাঝখানে ছিল ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিণ্টন। এখন তরুণরা ঘরে বসে খেলছে ভিডিও গেমস, ইন্টারনেটভিত্তিক বিচিত্র খেলা। গ্রামে প্রতিটি সমাজে ছিল বিনোদনের কত আয়োজন। আয়োজন হতো পালাগান, যাত্রাগান, জারি-সারি-ভাটিয়ালি, মারফতি, কবি গান, পুঁথিপাঠ ও বাউল গানের আসর। পুরানো এসব বিনোদনের স্থান দখল করেছিল সিনেমা, থিয়েটার, টেলিভিশন। এখন এগুলোও বিলুপ্তির পথে। এসেছে ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বিনোদন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মুখ গুঁজে বসে থাকে মোবাইল বা ল্যাপটপের পর্দায়। বাঙালির উৎসব আনন্দে পহেলা বৈশাখের প্রভাব কমেছে। চৈত্রসংক্রান্তির মেলার কথা বর্তমান প্রজন্ম ভুলতেই বসেছে। গ্রামের বিশাল বটবৃক্ষের নিচে কিংবা নদীর তীরের সেই মেলা এখন শুধুই অতীত। মধ্যবিত্ত শ্রেণি গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে। ভুলতে না পেরে শহরেও আয়োজনের চেষ্টা করছে বিষয়ভিত্তিক মেলার। গ্রামীণ মেলা, হস্তশিল্প মেলা, পিঠা মেলা, মৌসুমি ফলের মেলা, মধু মেলা ইত্যাদি। গ্রামের সেই মেলার অনুভব নেই কোনো আয়োজনে। যান্ত্রিক আয়োজনের মেলাগুলো যেন শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। মুসলমানদের ঈদ, হিন্দুদের দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা, কালীপূজা, খ্রিস্টানদের বড়দিন ছিল সামাজিক অনুষ্ঠান। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ছিল সমাজের সকলের অধিকার। এখন ধর্মীয় বিভেদ, সাম্প্রদায়িক চিন্তার বিকাশ এবং নানা ধরনের মতামতে এগুলো ধর্মীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এসব সামাজিক অনুষ্ঠানের চেয়ে এখন থার্টি ফার্স্ট নাইট, ভ্যালেন্টাইনস ডে, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের দাপট অনেক বেশি।
সমাজের এই পরিবর্তন এসেছে সময়ের প্রয়োজনে। প্রযুক্তির উৎকর্ষে যুগে বদলে গেছে মানুষের মনমানসিকতা এবং জীবনধারা। হাতের কাছে সহজলভ্য সুবিধা ছেড়ে নতুন প্রজন্ম আর মাঠে যেতে চায় না। একটা সময় মানুষের চাহিদা ছিল কম। দু’মুঠো খাবারের ব্যবস্থা, মাথা গোঁজার ঠাঁই, পরনের কাপড় নিশ্চিত হলে সবাই খুশি ছিল। সময়ের ব্যবধানে এখন চাহিদা বেড়েছে অনেক। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে মানুষের অন্ন সংস্থানের পাশাপাশি এখন গাড়ি-বাড়ি-বিলাসিতা হয়ে উঠেছে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। নাগরিক জীবনে টেলিভিশন, ফ্রিজ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র এখন বিলাসিতার পরিবর্তে মৌলিক চাহিদায় পরিণত হয়ে উঠেছে। রাস্তায় লক্কড়-ঝক্কড় মুড়ির টিন বাসের জায়গায় মানুষ অনেক বেশি ভাড়া দিয়ে হলেও চাচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহন। যার একটু সামর্থ্য আছে তারা কিনছেন প্রাইভেটকার। রোদ-বৃষ্টি, শীত-গরম, ধুলাবালি ও ঘাম ঝরিয়ে গ্রামের দিকে ছুটে যেতে অনীহা তৈরি হচ্ছে সবার মাঝে। গ্রামাঞ্চলেও লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন। টেলিভিশন নেই এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আগে গ্রামের মানুষ ৮/১০ মাইল দূরে হেঁটে বাজারে যেত পণ্য কেনাবেচার জন্য। এখন এসেছে অবকাঠামোতে পরিবর্তন। গ্রাম থেকে গ্রামে জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে পিচঢালা পথ। কেউ আর হাঁটতে চায় না। প্রথমে রিক্সা, এখন অটো চলছে প্রতিটি গ্রামে। রাজধানী ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ছাড়া পায়ে চালানো রিক্সা এখন কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
পরিবর্তনের হাওয়া ঠেকানোর সাধ্য কারও নেই। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তির উন্নয়নে ছোট হয়ে গেছে বিশ^। এখন যে কেউ চাইলেই ফোনে কথা বলতে পারেন সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে আপনজনের সঙ্গে। পকেটে টাকা থাকলে কেউ লক্কড়-ঝক্কড় মুড়ির টিন বাসে উঠতে চাইবে না। দ্রুত চলাচলের জন্য প্রাইভেটকার প্রয়োজন। চাইলেও কাউকে মোবাইল ফোন, ফেসবুক, ইউটিউব থেকে দূরে সরানো যাবে না। আমাদের শুধু চেষ্টা করতে হবে যাতে নতুন প্রজন্ম তাদের শিকড়ের কথা ভুলে না যায়। শিকড় উপড়ে গেলে তৈরি হবে জাতিগত সংকট। আধুনিকতার মাঝেই তাদের খুঁজে নিতে হবে পুরানো ঐতিহ্য। বাঙালি সংস্কৃতি আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। গ্রামের স্নিগ্ধ বাতাস, ঐতিহ্যবাহী খাবার, জারি-সারি-ভাটিয়ালি গানের মন মাতানো সুর, গ্রামের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদী, হাওড়-বাঁওড়, নৈসর্গিক প্রকৃতি এখনো যাদের ভালো লাগে, দায়িত্ব নিতে হবে তাদেরই। আগামী প্রজন্মকে বোঝাতে হবে শিকড়ের মূল্য। তবেই টিকে থাকবে আমাদের সমাাজিক-পারিবারিক বন্ধন। যান্ত্রিক যুগে আধুনিকতার পাশাপাশি টিকে থাকবে জাতিগত ঐতিহ্য।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, জনকণ্ঠ