বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি হলো নতুন ব্যবসার উদ্ভব এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি। জীবিকা নির্বাহ ও আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার জন্য পৃথিবীর সর্বোত্তম এবং হালাল মাধ্যম হলো ব্যবসা। যার মাধ্যমে নিজে যেমন আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠা যায় অন্যকেও কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়। কিন্তু বর্তমান সমাজে মানুষের মধ্যে ব্যবসা বিমুখতার যে প্রবণতা দেখা যায়, তা বেকারত্ব বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে নতুন বছরে দেশের বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে ২৬ লাখ ৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। এসব উচ্চ শিক্ষিত মানুষ বেতনভিত্তিক চাকরির পিছনে না দৌড়ে নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে ব্যবসায় মনোনিবেশ করলে একদিকে যেমন নিজেদের কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা হতো অন্যদিকে সে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার মাধ্যমে আরও অনেকের কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থা হতো। আমাদের সমাজে ব্যবসাকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়, চাকরি কে ব্যবসার চেয়ে বেশি সম্মান দেওয়া হয়। যে কারণে মানুষ নতুন করে উদ্যোগ নিয়ে ব্যবসা শুরু করার আগ্রহ প্রকাশ করে না। একটি ব্যবসা দাঁড় করানোর চেয়ে বেশি ভয় থাকে ব্যবসায় ব্যর্থ বা লোকসানের মুখোমুখি হলে সামাজিক লজ্জা পেতে হবে। এটি আমাদের সমাজ বা দেশের অনেক বড় একটি সমস্যা, যার ফলে তরুণ সমাজ ব্যবসার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করতে বিমুখ হচ্ছে।
চীনের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বলেছেন, আপনি যদি বানরদের সামনে কলা এবং টাকা রাখেন তবে বানররা কলা বেছে নেবে। কারণ তারা জানে না যে, টাকা দিয়ে অনেক কলা কেনা যায়। ঠিক তেমনি আপনি যদি মানুষকে কাজ এবং ব্যবসার প্রস্তাব দেন, তারা কাজ করা বেছে নেবে। কারণ বেশিরভাগ লোকই জানে না যে, একটি ব্যবসা বেতনের চেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারে। কেন দরিদ্ররা বেশিরভাগ সময় দরিদ্রই থেকে যান? কারণ তারা স্কুলে অনেক সময় ব্যয় করেন এবং তারা নিজের জন্য কাজ করার পরিবর্তে বেতনের বিনিময়ে অন্যের কাজ করেন। বেতনের উপার্জন দিয়ে বেশিরভাগ মানুষ জীবনধারণের ব্যয় নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত উপার্জন মানুষের ভাগ্য পাল্টে দিতে পারে।
সরকারি অবকাঠামোগত সুবিধার অভাব একটি দেশের ব্যবসাভিত্তিক উদ্যোগগুলোর সামনে অনেক বড় বাধার সম্মুখীন হয়। বিদ্যুৎ, পরিবহন এবং আধুনিক প্রযুক্তির সুব্যবস্থা না থাকার কারণেও অনেকের ব্যবসার প্রতি বিমুখতা তৈরি হয়ে থাকে। পাশাপাশি, সঠিক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাবও অনেকের উদ্যোক্তা হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উদ্যোক্তাদের ব্যবসা বিমুখতা কাটাতে এবং বেকারত্বের হার কমিয়ে আনতে এসব সমস্যার সমাধান করা জরুরি, এসব সমস্যার সমাধান না হলে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি অসম্ভব।
মানুষের ব্যবসা বিমুখতা কাটাতে সরকারের যে দুটি দিকে জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করি, তা হলো প্রশিক্ষণভিত্তিক কর্মশালার ব্যবস্থা করা এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা। দক্ষতার অভাবে যারা উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্যবসা কার্যক্রম সক্রিয় করতে পারছেন না তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং যারা মোটামুটি দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছেন তাদের সঠিকভাবে কাজে লাগানো ও উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আরও দক্ষ করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি, যেমনÑ সারা দেশে পরিবহন ব্যবস্থার সুব্যবস্থা করা, বিদ্যুৎ পানি সরবরাহ সবসময় সচল রাখা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা। বর্তমান সময়ে এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সবদিক দিয়ে আপনার সক্রিয়তা বজায় রাখবে। তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণপ্রদান এবং ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তাদের পথ সুগম করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সমাজে ব্যবসার প্রতি ইতিবাচক মনোভাবও তৈরি করা জরুরি। এক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থায় উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ব্যবসা হলো বেকারত্ব দূর করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি শুধু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে না, বরং অর্থনীতির বৃদ্ধি এবং সমাজের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে।
ব্যবসায়ের কয়েকটি ইতিবাচক দিক হলো Ñ
১. স্বল্প ও মাঝারি শিল্প উন্নয়ন : এই ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানে বেশি সংখ্যক কর্মচারী নিয়োগ করা যায়। এছাড়াও, এগুলো স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল ব্যবহার করে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে জোরদার করে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে।
২. উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা : সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ এবং ঋণ সুবিধা বাড়ানো হলে নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। সেই সঙ্গে বেকারত্বও অনেকাংশে দূর করা সম্ভব হবে।
৩. ফ্রিল্যান্সিং ও অনলাইন ব্যবসায় উৎসাহিত করা : ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসে কাজ করে আয় করার সুযোগ বাড়ছে। বর্তমানে মানুষ অনলাইননির্ভর হওয়াতে এই ধরনের ব্যবসার অনেক গুরুত্বসহ দেখা উচিত, সরকারকে এই খাতে প্রশিক্ষণ এবং প্রচারণার মাধ্যমে সহযোগিতা করা দরকার।
৪. পর্যটন খাত উন্নয়ন : বাংলাদেশসহ আধুনিক বিশ্বে পর্যটন শিল্প সবচেয়ে সম্ভবনাময় একটি খাত, পর্যটন খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্যুর অপারেটর ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে পর্যটন খাতকে জোরদার করা যেতে পারে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টির অপার সম্ভবনাময় একটি মাধ্যম।
৫. কৃষি খাতে আধুনিকায়ন : কৃষি খাতে যান্ত্রিকীকরণ এবং আধুনিক কৃষি পদ্ধতির প্রয়োগ করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ফলে বিভিন্ন প্রকার ব্যবসার চাকা সচল থাকবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।
আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে অন্য সবকিছুর পাশাপাশি সৃজনশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করার মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। সর্বোপরি ব্যবসাবিমুখতা কাটিয়ে উঠতে পারলে বেকারত্বের হার কমিয়ে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। তাই সরকার, সমাজ এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সবাইকে একযোগে কাজ করা প্রয়োজন।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া